স্ত্রীকে ছেড়ে দেওয়া, না পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে সম্পর্ক বজায় রাখা?

ফতওয়া কোডঃ 222-তাখু-23-04-1446

প্রশ্নঃ

আসসালামু আলাইকুম, মুফতি সাহেব। আমি জেনারেল শিক্ষিত দ্বীন প্র্যাক্টিসিং একজন যুবক। আমার বর্তমান বয়স ২২ বছর এবং আমার স্ত্রীর বর্তমান বয়স ১৫ বছর। ২০২২ সালের প্রথম দিকে আমি আমার বাবার চাচাতো ভাইয়ের মেয়ে (চাচাতো বোন) এর সাথে হারাম রিলেশনশিপে যুক্ত হই। দ্বীনের বিষয়ে একেবারেই তখন অজ্ঞ হওয়ার কারণে যেনার ভয়াবহতা সম্পর্কে আমি ছিলাম প্রায় জ্ঞানহীন। যখনি জানলাম যে, দুইজন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ সাক্ষীর সরাসরি উপস্থিতিতে নারী-পুরুষের পরস্পরের ইজাব কবুলের মাধ্যমে বিয়ে সংঘটিত হয়, ঠিক তখনি দেরি না করে আমরা পরিবারকে না জানিয়েই বিয়ে করে ফেলি। সেটা ২০২২ সালেরই সেপ্টেম্বরের ঘটনা। সে সময়ের আমার সামর্থ্য অনুযায়ী মোহরানা ১০,০০০ টাকা ধার্য্য করেছিলাম। ৫,০০০ টাকা বিয়ের দিন রাতে আমি পরিশোধ করেছি। আর বাকি টাকা সে তখন আমাকে মাফ করে দিয়েছিল।

বিবাহের পর আলহামদুলিল্লাহ আমাদের সবকিছুই সঠিকভাবে চলছিল। আমরা উভয়ই পূর্ববর্তী সকল হারাম কাজের জন্য খাস দিলে তওবা করেছিলাম। কিন্তু, পরিবারের কাছে আমাদের সম্পর্কের বিষয়টা বেশিদিন গোপন থাকল না। মেয়ের পরিবার আমাদের সম্পর্কটা জানার পর খুব সমস্যা তৈরি করল। তারা মূলত আমাদের সম্পর্ককে অবৈধ সম্পর্ক হিসাবে ধরে নিয়েছিল। এরপর ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে যখন জানল যে আমরা বিয়ে করেছি তখন আমাকে নিয়ে গিয়ে জোরপূর্বক তালাক নিয়েছিল। তখন পরিস্থিতি এতোটাই ভয়াবহ ছিল যে, যদি আমি তাদের কথা মেনে না নিতাম মানে তালাক না দিতাম তাহলে তারা আমার এবং আমার পরিবারের শারীরিক এবং আর্থিক উভয় ক্ষতিসাধন করতে পারতো খুব সহজেই। মাসআলা জানার কারণে তখন আমি মনে মনে এক তালাকের নিয়তে আমার স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে একবার বলেছিলাম যে, “আমি তোমাকে তালাক দিলাম”। স্থানীয় মুফতির কাছে জেনেছি উক্ত কথায় এক তালাকে রজয়ী হয়েছে, যা ফেরতযোগ্য। এরপর আমি তাকে ২ দিনের মধ্যে আবারও মৌখিকভাবে ফিরিয়ে নিই। উল্লেখ্য যে, আমি তালাক দিয়েছিলাম আমার শ্বশুর শাশুড়ির সামনে। কিন্তু, ফিরিয়ে নিয়েছিলাম মোবাইল কলের মাধ্যমে কোনো সাক্ষী ছাড়া, একাকী।

আমার স্ত্রীও আমার মতো দ্বীন প্র্যাক্টিসিং হওয়ায় সে আলহামদুলিল্লাহ বিয়ের পর থেকেই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এবং পরিপূর্ণ পর্দা মেনে চলার চেষ্টা করলে প্রচন্ড বাঁধার সম্মুখীন হয়। বিশেষ করে পর্দার বিষয়ে সে শারীরিক এবং মানসিকভাবে প্রচন্ড নির্যাতনের স্বীকার হয়। একবার তার বাবা তার মুখ ঢাকার নেকাব ছিঁড়ে ফেলে এবং প্রচন্ড মারধর করে। তার মা তাকে এমনভাবে বলে যে, “তার বয়সী মেয়েদের নাকি ওড়নাও ইউজ করা লাগে না”। নামাজ একটু বেশি সময় নিয়ে পড়লে এবং মুনাজাত একটু বড় করে ধরলে তার মা তাকে প্রচন্ড অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করে। অপ্রয়োজনে ঘর থেকে না বের হলে এবং পর্দা নিয়ে চললে তাকে জেএমবি এবং তালেবান জঙ্গি বলা প্রতিদিনের ঘটনা। মসজিদে আমি ফজরের আযান দিলে সে নামাজের জন্য উঠার কারণেও প্রচন্ড গালাগালি করে। আমার স্ত্রী আমার কাছে আসার জন্য একেবারেই রাজি। সে সবসময় আমাকে বলে তাকে যেন এই অত্যাচার থেকে আমি মুক্তি দিই।

আমার শ্বশুর শাশুড়ির মূলত সমস্যা দুইটা। এক. আমার অর্থ-সম্পদ কম হওয়া। যদিও এই কুফু বিবেচনায় আমি তাদের থেকে কয়েকগুণ এগিয়ে। দুই. আমার ইসলামিক চলাফেরা। এই দুইটি কারণে তারা কোনোভাবেই আমার কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে রাজি হয় নি। আমি এখন বর্তমানে সরকারি চাকরি করি। নতুন চাকরি পেয়েছি। পরবর্তীতে আমি সকলের সামনে প্রস্তাব দিলেও তারা রিজেক্ট করে দেয়। আমার পরিবারও মেয়ের পরিবারের দিক বিবেচনায় আমার প্রস্তাবে রাজি হয় নি। যদিও আমরা গোপনে আজও স্বামী-স্ত্রী। এখন এটা কেউ জানে না। আমার শাশুড়ি আমার নামে মামলা করার বিভিন্ন হুমকি ধমকি দিচ্ছে। আমার পরিবারও আমাদের বিষয়ে একদম রাজি না। যদিও সম্পর্কটা গোপন আছে। আমার স্ত্রীকে আমার করে রাখতে হলে সকলের বিরুদ্ধে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তাগুতের আইন হওয়ার কারণে আমি বিয়ের কথাটাও স্বীকার করতে পারছি না। কারণ, এতে করে তারা আমার নামে বাল্যবিবাহ এবং ধর্ষণ উভয় মামলা খুব সহজে দিতে পারে। উল্লেখ্য, আমার স্ত্রী ইসলাম পালনের জন্য কঠিন নির্যাতন সহ্য করছে। ইসলামকে সামনে রেখে আমি চাচ্ছি না যে, আমার স্ত্রীকে ছেড়ে দিতে।

এখন সম্মানিত মুফতির কাছে আমার প্রশ্ন, উপরের পরিস্থিতি বিবেচনায় আমাকে কি সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত? স্ত্রীকে ছেড়ে দেওয়া, নাকি নিজ পরিবার এবং বাকি সকলের বিরুদ্ধে গিয়ে স্ত্রীর সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখা।

সমাধানঃ

بسم اللہ الرحمن الرحیم

বিবাহ মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নারী-পুরুষের সারাজীবনের চিরস্থায়ী পূত-পবিত্র বন্ধন ও বিশেষ একটি নেয়ামত এবং রাসুল সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। চারিত্রিক অবক্ষয় রোধ, আদর্শ পরিবার গঠন, মানুষের জৈবিক চাহিদাপূরণ ও মানবিক প্রশান্তি লাভের প্রধান উপকরণ। বিয়ে ইসলামী শরিয়তের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান। তাইতো ঘোষণা না দিয়ে এবং আপনজনকে না জানিয়ে গোপনে বিয়ে করা অসামাজিক ও লজ্জাজনক কাজ। বিয়ের ক্ষেত্রে গোপনীয়তা ইসলাম পছন্দ করে না। তাইতো বিভিন্ন কল্যাণের কথা বিবেচনা করে ঘোষণা দিয়ে বিয়ে করার কথা বলেছে এবং গোপন বিয়েকে নিরুৎসাহিত করেছে।

আম্মাজান হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক সাহাবির বিয়ের খবর শুনে নির্দেশ দেন, তোমরা বিবাহ অনুষ্ঠানকে প্রকাশ্যে ঘোষণা কর, মসজিদে এটিকে উদযাপন কর এবং দফ (এক ধরণের বাদ্যযন্ত্র বিশেষ) বাজাও। (তিরমিযী: ১০৮৯) বিয়ের ক্ষেত্রে ইসলামী শরিয়তে অভিভাবকের অভিমত গুরুত্বপূর্ণ। এক হাদিসে এ বিষয়ে তাগিদ দিয়ে আল্লাহর রাসুল সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘অভিভাবক ছাড়া বিয়ে সংঘটিত হয় না। আর ইসলামে তালাক একটি জঘন্যতম বৈধ কাজ, এর বৈধতা দেয়া হয়েছে খুবই অপছন্দনীয়ভাবে।

হাদিসে বর্ণিত হয়েছে ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত হালাল হলো তালাক।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ২১৭৭) এজন্য অতি প্রয়োজন (শরয়ী ওজর) ছাড়া স্বামীর জন্য তালাক দেওয়া জায়েজ নয়, স্ত্রীর জন্যও তালাক চাওয়া বৈধ নয়। আর স্বামী এক্ষেত্রে নিছক মা-বাবার চাপ বা বলপ্রয়োগের কারণেও তা প্রয়োগ করা উচিত নয়, রসূল সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ স্রষ্টার অবাধ্যতায় সৃষ্টির কোন আনুগত্য নেই। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭১৪৫)

এমতাবস্থায় আপনার করণীয় হচ্ছেঃ আপনি আপনার মা-বাবা ও পরিবারের সাথে এ বিষয়ে খোলাখুলি আলোচনা করুন। আপনি তাদের সাথে যে অকৃতজ্ঞতাপূর্ণ আচরণ করেছেন, তা তাদের কাছে স্বীকার করে নিন এবং এ বিয়ে বহাল রাখার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করুন। আপনার কথায় কাজ না হলে এমন কারো সহযোগিতা নিন যার কথা আপনার পরিবার মেনে নেবে। এরপরেও যদি তারা তালাকের কথা বলে এবং তাদের কথা সঠিক ও যুক্তিসঙ্গত হয় অথবা আশু বিপদ বা মামলা মুকাদ্দমা থেকে রক্ষার জন্য হয় এবং সে কারণে তালাক ছাড়া আর কোনো পথ বাকি না থাকে, পাশাপাশি যদি তালাক প্রদান করার দ্বারা আপনার জিনায় জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা না থাকে, তাহলে মাতা-পিতার সন্তুষ্টির জন্য স্ত্রীকে তালাক দিতে হবে।

হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমর রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার একজন স্ত্রী ছিল। যাকে আমি ভালবাসতাম। কিন্তু আমার পিতা তাকে অপছন্দ করতো। তিনি আমাকে তাকে তালাক দিতে বললে আমি তালাক দিতে অস্বীকৃতি জানালাম। তখন আমার পিতা রসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে বিষয়টি উপস্থাপন করলে রসুল সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তাকে তালাক দিয়ে দিতে। ফলে আমি আমার স্ত্রীকে তালাক প্রদান করি। (আবু দাউদ, হাদিস : ৫১৩৮) পক্ষান্তরে তালাকের কারণ যদি যৌক্তিক না হয়, কেবল বউ বা তার পরিবারের প্রতি হিংসা বা বিদ্রুপ মনোভাবের কারণে এটি হয়, তাহলে তালাক দেওয়া আপনার জন্য জায়েজ হবে না।

সুত্রসমূহ

صحيح مسلم: رقم 1840 لا طَاعَةَ في مَعْصِيَةِ اللهِ، إنَّما الطَّاعَةُ في المَعروفِ

 سنن أبي داؤد: رقم 5138 عن حمزة بن عبد الله بن عمر عن أبيه قال: كانت تحتي إمرأة وكنت أحبها وكان عمر يكرهها فقال لي طلقها فابيت فاتى عمر النبي ﷺ فذكر ذلك له فقال النبي صلى الله عليه وسلم طلقها

سنن الترمذي: رقم 1089 عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ: أَعْلِنُوا هَذَا النِّكَاحَ، وَاجْعَلُوهُ فِي المَسَاجِدِ، وَاضْرِبُوا عَلَيْهِ بِالدُّفُوفِ

سنن أبي داؤد: رقم 2178 عن إبن عن النبي ﷺ قال: ابغض الحلال إلى الله عز و جل الطلاق

رد المحتار: 4/66 ویندب إعلانه وتقدیم خطبة وکونه في مسجد یوم جمعة بعاقد رشید وشهود عدول

والله اعلم بالصواب

দারুল ইফতা, রহমানিয়া মাদরাসা সিরাজগঞ্জ, বাংলাদেশ।

Loading

Scroll to Top