মাওলানা সা’দ সাহেব এর বয়ান শোনা বা প্রচার করা জয়েয নয়

ফতওয়া কোডঃ 201-আ,মামা-28-11-1444

প্রশ্নঃ

দারুল উলুম দেওবন্দের পক্ষ থেকে মাওলানা সাদ সাহেবের ব্যাপারে সর্বশেষ ফতওয়া জানতে চাই, এবং এ ব্যাপরে আপনাদের মতামতও জানতে চাই।

সমাধানঃ

بسم اللہ الرحمن الرحیم

গত ১৮ জুন ২০২৩ ইং মুতাবিক ২৮ যিলকদ ১৪৪৪ হিজরিতে মাওলানা সাদ সাহেব সম্পর্কিত একটি ইস্তিফতার উত্তরে দারুল উলূম দেওবন্দ ভারতের ফতওয়া বিভাগ থেকে একটি ফতওয়া প্রকাশিত হয়, রহমানিয়া ইমাদদুল উলুম মাদরাসা সিরাজগঞ্জ, বাংলাদেশ এর কেন্দ্রীয় দারুল ইফতার সম্মানিত মুফতি সাহেবগন উক্ত ফতওয়ার সাথে একমত পোষণ করেছেন, নিচে পুরো ফতওয়া উল্লেখ করা হলো।

প্রশ্ন নং : 11360-805/B=11/1444

بسم اللہ الرحمن الرحیم

শ্রদ্ধেয় হযরত মাওলানা মুফতি আবুল কাসেম নুমানি দামাত বারাকাতুহুম ও দারুল উলূম দেওবন্দের সকল সম্মানিত মুফতি বরাবর

আস সালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।

আপনাদের সকাশে নিবেদন হলো, তাবলীগ জামাতের একজন পরিচিত ও উঁচু পদের যিম্মাদারের পক্ষ থেকে অজ্ঞতাপূর্ণ কথা দিনদিন বেড়েই চলেছে। আমরা রমাযানের পূর্বে ভূপাল ইজতিমা ২০২২ ই. আলেমদের মজলিসের বয়ান আপনাদেরকে জানিয়েছিলাম। যা পড়ে আপনারা মে․খিকভাবে আফসোস ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো লিখিত উত্তর পাইনি। সম্প্রতি এপ্রিল ২০২৩ ই. এর নতুন বয়ান সামনে এসেছে। সেই বয়ানে তিনি উলামায়ে কেরাম ও মাদরাসার পরিচালকদেরকে দ্বিধায় ফেলে দিয়েছেন। আমরা হতভম্ব যে, একজন লোক গোটা দুনিয়ার সকল আলিম ও বুজুর্গদেরকে ধিক্কার দিয়ে বলছেন যে, ব্যবসা করাটা আলিমদের জন্যে জনসাধারণ অপেক্ষা অধিক জরুরি। দ্বীনের খাদিমদের দায়িত্ব হলো, নিজের ভরণ-পোষণের বন্দোবস্ত নিজেই করা। এর অন্যথা হলে দ্বীনের জন্যে তাদের সকল চেষ্টা-সাধনা ত্রুটিপূর্ণ। জনগণ ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পালন করবে, এটি ভুল ধারণা।

তিনি পরিস্কার শব্দে এ কথা বলেছেন

“রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেকে এবং তাঁর খুলাফায়ে রাশেদিনকে এভাবে অভ্যস্ত করেছিলেন যে, তোমাদের কাছে কোনো সম্পদ এলে প্রত্যাখ্যান করবে। তোমাদের দ্বীনি খিদমতের কারণে তোমাদের কাছে কোনো সম্পদ পেশ করা হলে তা গ্রহণ করবে না। সাহাবায়ে কেরাম জানতেন না যে, পারিশ্রমিক ও সাওয়াব কীভাবে একত্র হতে পারে! অথচ এ যুগের লোকেরা বলে যে, সাওয়াবও পাবে, আবার পারিশ্রমিকও পাবে। অথচ সাহাবায়ে কেরাম জানতেন না যে, দ্বীনের কোনো খিদমতের জন্যে পারিশ্রমিক নিলে আমাদের সাওয়াব বাকি থাকবে। সাহাবায়ে কেরাম তা জানতেন না। পরবর্তী যুগের লোকেরা তাবিল (অপব্যাখ্যা) করে নিজেরা অভাবমুক্ত হওয়া সত্ত্বেও দ্বীনের খিদমতের জন্যে পারিশ্রমিক গ্রহণ করার অভ্যাস বানিয়ে ফেলেছে। অভাবমুক্ত হওয়া সত্ত্বেও এ কাজ করছে। অথচ সাহাবায়ে কেরাম অভাবী হওয়া সত্ত্বেও দ্বীনি খিদমতের ওপর বিনিময় গ্রহণ করতেন না।

অথচ এ যুগের লোকেরা এটাকে অভ্যাস বানিয়ে ফেলেছে। আমি মনে করি, একজন শিক্ষক মাদরাসায় পড়ানোর পাশাপাশি ব্যবসা করবেন। যারা মাদরাসায় পড়ান না, তাদের ব্যবসা করার তুলনায় মাদরাসা শিক্ষকদের ব্যবসা করা অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি। প্রত্যেক শিক্ষক, মুহাদ্দিস, আমির ও মুবাল্লিগ নিজেদের দ্বীনি খিদমতের পাশাপাশি ব্যবসা করবেন। যেসব সাধারণ অজ্ঞ মানুষ কোনো সম্মিলিত কাজের দায়িত্ব পালন করছেন না, তাদের ব্যবসা করার তুলনায় আলিমদের ব্যবসা করা অধিক জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ জনগণের জন্যে ব্যবসা করাটা ততটা জরুরি নয়। বুজুর্গানে দ্বীন, উলামা ও মুবাল্লিগগণ দুনিয়াবি কাজে লিপ্ত হলে দ্বীনের মাঝে ব্যঘাত সৃষ্টি হবে জানি না, কোত্থেকে এই মানসিকতা গড়ে উঠেছে! কোত্থেকে এই বিষয় সৃষ্টি হয়েছে! অথচ আমি মনে করি, এর ফলে তাদের মেহনতের সহায়ক হবে।

আজ তারা কিতাব থেকে ব্যবসা সংক্রান্ত অধ্যায় পড়াচ্ছেন। অথচ তার থেকে উত্তম হলো, তারা নিজেরাই বাজারে বসে উম্মতকে প্র্যাক্টিক্যাল ব্যবসা শেখাবেন। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো, এ যুগে কাফেরদের মতো মুসলমানরাও আলিম ও বুজুর্গদের ব্যবসা করাকে দুষণীয় মনে করে। যেভাবে কাফেররা নবিদের কোনো পার্থিব কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়াকে অপরাধ মনে করতো, এ যুগের মুসলমানরাও তদ্রƒপ আলিম ও বুজুর্গদেরকে কোনো বাণিজ্যিক বা কোনো পার্থিব কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়াকে দোষ মনে করে। আমি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছি। একজন মাদরাসা শিক্ষকের ব্যবসা করা একজন নন-আলিম ব্যক্তির ব্যবসা করা থেকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি। কারণ দুটি। যেন তারা সৃষ্টিজীব থেকে অমুখাপেক্ষী হয়ে দ্বীনের খিদমত করতে পারেন। দ্বিতীয় যে কারণটি বলছি, তা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তা হলো আবু বকর রাদি. এর আমল।

(তিনি বলেছিলেন,) ‘খিলাফতের দায়িত্ব আমাকে ব্যবসা থেকে বাঁধা দিতে পারবে না।’ আপনি ভেবে দেখুন। সকল মুসলমানের সমস্ত যিম্মাদারি তাঁর ওপর। যত দূর ইসলাম ছড়িয়েছে, সেখানকার সকল মুসলমানের তিনি আমির। তাহলে তার যিম্মাদারিতে কত বেশি কাজ হতে পারে! এত বেশি ব্যস্ততা সত্ত্বেও তিনি ব্যবসা করাকে খিলাফতের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক মনে করছেন না। এটাকে দোষ মনে করছেন না। হযরত উমর রাদি. আপত্তি তুলে বলেছিলেন যে, আপনার ব্যবসা খিলাফতের দায়িত্ব পালনে বিঘ্ন হবে। তিনি উত্তরে বলেন, ‘কীভাবে বিঘ্ন হবে? আমি এই দায়িত্বও পালন করব, ব্যবসাও করব।’ আলিমদের ব্যবসা করার আরেক কারণ হলো, তারা যেন বাজারঘাটে যান, আইন-আদালতে যান। ব্যাংকিংসহ পৃথিবীর সকল শাখায় প্রবেশ করেন, যেন পার্থিব সকল শাখায় মুসলমানগণ তাদের সাথে প্র্যাক্টিক্যাল যোগাযোগ করে। এখন যে স্রেফ কিতাবি সম্পর্ক আছে, আমি তাকে দ্বীনের জন্যে যথেষ্ট মনে করি না। কিতাবি শিক্ষা কখনই প্র্যাক্টিক্যাল শিক্ষা নয়। আপনারা ননপ্র্যাক্টিক্যাল শিক্ষাকেই একমাত্র শিক্ষা মনে করে বসে আছেন। কথাগুলো বুঝতে পারছেন? কিতাবি শিক্ষার মতো ননপ্র্যাক্টিক্যাল শিক্ষাকেই একমাত্র শিক্ষা মনে করে বসে আছেন। শিক্ষাকে অব্যবহারিক করে রেখেছেন।

হযরত উমর রাদি. এর শাসনামলে কারো জন্যে এই অনুমতি ছিল না যে, ব্যবসার বিষয়াদি ও তৎসংশ্লিষ্ট বিধি-বিধানের পরীক্ষা না দিয়ে কেউ মদিনাতে দোকান খুলবে। আমরা তো মুসলমানদেরকে নামায-রোযা শেখাতে চাই। আমরা তাদেরকে ইসলামি ব্যবসা দেখাতে চাই। মদিনায় এসে ব্যবসার ইসলামি পদ্ধতি দেখে যাও। এজন্যে আমি নিবেদন করছি যে, ছাত্র বা শিক্ষক- প্রত্যেকের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব অন্য কেউ নেবেÑ এটা ভুল ভাবনা। আমি মনে করি, এর ফলে ছাত্র ও শিক্ষক, উভয়ের মুজাহাদা ত্রুটিপূর্ণ হয়ে যায়। শিক্ষকের মুজাহাদাও ত্রুটিপূর্ণ। ছাত্রের মুজাহাদাও ত্রুটিপূর্ণ। তারা তো খুশি যে, সমাজের ধনী ব্যক্তিরা আমাদের সকল প্রয়োজন পূরণের যিম্মাদারি পালন করছেন। কাজেই আমাদের কিছু করার কী প্রয়োজন! শিক্ষাকও খুশি, ছাত্রও খুশি। শরিয়তের মূল উত্তম বিধান (আজিমত) যখন খতম হয়ে যায় তখন রুখসত (জায়েজ ছাড় বিধান)-ই প্রত্যেকের অভ্যাসে পরিণত হয়।

এখন কেউ আজিমতের বয়ান দিলে মানুষ মনে করে, সে বুঝি রুখসতের বিধানকে অস্বীকার করছে। এজন্যে তারা বরদাশত করতে পারে না। তারা মনে করে, আমাদের খণ্ডন করা হচ্ছে। আসলে এটি আপনাদের খণ্ডন নয়; বরং মূল বিধানের দিকে আপনাদের মনোযোগ আকর্ষণ জরুরি। আমার বক্তব্য হলো, শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণের পাশাপাশি নিজের সকল প্রয়োজন পূরণের নিজেই যিম্মাদার হওয়া সাহাবায়ে কেরামের, খুলাফায়ে রাশেদিনের, সকল নবি-রাসূলের ক্সবশিষ্ট্য। এটি শুধু জরুরতই নয়; সিফাত (ক্সবশিষ্ট্য)। জরুরত তো যেনতেনভাবে পূরণ হয়ে যাবে। আমি বলি, এটি হলো সিফাত যে, নবিগণ ব্যবসা করতেন। প্রত্যেক নবির কোনো না কোনো পেশা ছিল। কেউ লে․হকার ছিলেন। কেউ কাঠমিস্ত্রি ছিলেন। এ যুগের মুসলমানরা যেসব কাজকে দোষ মনে করে, নবিগণ সেসব কাজ করেছেন। অথচ সেগুলোকে এ যুগে দোষ মনে করা হয়। আপনারা আজ এমন স্থানে পৌছে গেছেন যে, শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি কোনো ভালো ব্যবসা করাকেও আপনারা দোষ মনে করছেন!” (হায়াতুস সাহাবার তালিম, ২৯ এপ্রিল ২০২৩ ই.)

হে শীর্ষস্থানীয় উলামা হযরাত, তার এই বয়ান মারাত্মক গুমরাহি সৃষ্টিকারী মনে হচ্ছে। এর মাধ্যমে বয়ানকারী ব্যক্তি জনগণকে পরিস্কার এই অনুভূতি দিচ্ছেন যে, সমগ্র পৃথিবীতে তিনি একাই আজিমত (শরিয়তের মূল উত্তম বিধান) এর দিকে আহবান করছেন। এজন্যে আলিমগণ তার বিরোধিতা করছেন। আপনারা নিন্দুকের নিন্দার ভয় এড়িয়ে পূর্বেও একটি বড় পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। একটি সর্বসম্মত ফতোয়া জারি করেছিলেন। পরবর্তীতে আরেকটি লেখায় লিখেছিলেন যে, তিনি একটি নতুন দল বানাচ্ছেন। কিন্তু দারুল উলুম দেওবন্দের শত্রু, কতিপয় অদূরদর্শী লোক দারুল উলূম দেওবন্দ ও আমাদের আকাবিরের ওপর বেহুদা অপবাদ আরোপের মিশন শুরু করে দিয়েছিল। পর্ব আকারে প্রবন্ধ লিখেছে।

আমরা দেওবন্দের আকাবিরদের ওপর পূর্ণ আস্থা লালন করি যে, তারা হকের ব্যাপারে কখনই কারো দ্বারা প্রভাবিত হন না। আমরা আপনাদের কাছে ইতোপূর্বে আরো অনেকগুলো বয়ান পেশ করেছি। যার কোনোটায় আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের শানে বেয়াদবি হয়েছে। কিছু বয়ানে এই দাবি তোলা হয়েছে যে, বর্তমান সময়ের শিক্ষাদান ও দ্বীনের দাওয়াতের পদ্ধতি সুন্নাতপরিপন্থী। সেগুলো নিরীক্ষণ করার পর আপনাদের কাছে নিম্নোক্ত প্রশ্নগুলোর উত্তর প্রত্যাশা করছি।

(১) বয়ানকারীর উক্ত বয়ানগুলো কি শরিয়তের আলোকে সঠিক? এমন ব্যক্তির বিভ্রান্তিকর কথা কি অন্যদের কাছে পৌছানো ও প্রচার করা জায়েয?

(২) যারা এমন ব্যক্তির পক্ষে কথা বলে এবং ভুল দলিল সরবরাহ করে, তাদের ব্যাপারে শরিয়ত কী বলে?

(৩) কিছু লোক জনগণকে বোঝাচ্ছে যে, দারুল উলূম দেওবন্দের লোকজন সবসময় তাবলীগের বিরোধী ছিল। দারুল উলূম দেওবন্দ কি বাস্তবেই তাবলীগের বিরোধী? আমরা এই প্রশ্নগুলোর স্পষ্ট শব্দে উত্তর চাই। আমরা আপনাদেরকে এই তথ্য জানাতে চাই যে, দারুল উলুম দেওবন্দের দ্ব্যর্থহীন অবস্থান সামনে না আসার কারণে উলামায়ে কেরাম দ্বীনি পথপ্রদর্শনের ক্ষেত্রে নানাবিধ জটিলতার মুখোমুখি হচ্ছেন। অনেক ইমামের ইমামতি চলে যাচ্ছে। সব জায়গায় অস্পষ্ট ও পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা ছড়িয়ে পড়ছে। কেউ বলছে, ‘তিনি রুজু করেছেন। এজন্যে আমরা নিরুপায়। অতএব, আবারও দারুল উলুম দেওবন্দের শরণাপন্ন হোন। এই মাদরাসাই আমাদের জন্যে হককে হক হিসেবে চেনা ও বাতিলকে বাতিল হিসেবে জানার সবচেয়ে বড় কেন্দ্র।’ এজন্যে আমরা পরিস্কার শব্দে উল্লেখিত প্রশ্নগুলোর উত্তর চাই। আমাদের অনুভূতি ভুল হলে যেন সেই ভুলগুলো চিহ্নিত করে দেওয়া হয়। ওয়াস সালাম।

ফতোয়া জিজ্ঞেসকারী

১. আবদুর রশিদ। উসতায, মাদরাসায়ে যিয়াউল উলুম, মধ্যপ্রদেশ

২. মুহাম্মাদ খালেদ। উসতায, মাদরাসা আরাবিয়্যা, এমপি

৩. রফিক আহমদ। উসতায, দারুল উলূম মুহাম্মাদিয়া, এমপি

৪. মাওলানা মুফতি যিয়াউল্লাহ খান, শাইখুল হাদিস, জামিয়া ইসলামিয়া, ভুপাল

৫. যুবাইর আহমদ কাসেমি, উসতায, দারুল উলুম বাংলাওয়ালি

৬. জুনাইদ আহমদ কাসেমি, উসতায, দারুল উলূম সাগার, এমপি

৭. মুফতি ইনসাফ, উসতায, আনওয়ারুল উলূম ভুপাল

৮. মৌলভি যুবাইর, উসতায, উক্ত মাদরাসা

৯. মুহাম্মাদ ইরফান আলম কাসেমি, উসতায, ইরফানুল হুদা, ভুপাল

১০. মুহাম্মাদ আবরার, উসতায, যিয়াউল উলুম, এমপি

১১. মুহাম্মাদ মাহবুব কাসেমি, মুফতি, রাহাতগড়, সাগার, এমপি

১২. মুহাম্মাদ যুহাইর, কাজি, মধ্যপ্রদেশ

১৩. মুহাম্মাদ রিযওয়ান কাসেমি, উসতায, দারুল ইফতা, জামেয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া মসজিদে তরজমাওয়ালী, ভুপাল

উত্তরঃ 620801

بسم اللہ الرحمن الرحیم

الجواب، وبالله التوفيق

দারুল উলূম দেওবন্দ (৩১ জানুয়ারি ২০১৮ ঈ. তারিখে জারি করা) শেষ পত্রে উল্লেখিত ব্যক্তির চিন্তাধারা সম্পর্কে মন্তব্য করেছিল— “দারুল উলূম তার মতামত ও অবস্থান জানাতে গিয়ে মৌলিকভাবে ‘ফিকরি বে-রাহরবি’ (চিন্তাগত বিপথগামিতা)-এর বিষয়ে যে আশংকা প্রকাশ করেছে, তা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ কয়েকবার রুজু করার পরও সময়ে সময়ে তার এমনসব নতুন নতুন বয়ান অব্যাহত রয়েছে, যাতে সেই আগের মতোই মুজতাহিদসুলভ ভঙ্গি, দলীল-প্রমাণের ভুল প্রয়োগ এবং দ্বীনী দাওয়াত সম্পর্কিত তার নিজস্ব ভাবধারার ওপর শরয়ী দলীলের ভুল ব্যবহার জাজ্বল্যমান। ফলে দারুল উলূমের খাদেমগণই শুধু নয়, সামগ্রিকভাবে তার চিন্তাধারার বিষয়ে অন্যান্য হকপন্থী উলামায়ে কেরামেরও কঠিন পর্যায়ের অনাস্থা রয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, আকাবির (রহিমাহুমুল্লাহ)-এর ফিকির থেকে সামান্য বিচ্যুতিও অনেক বড় ক্ষতির কারণ। তাকে তার বয়ান-বক্তৃতায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সালাফের তরীকায় অবিচল থাকতে হবে। শরয়ী দলীল থেকে ব্যক্তিগত ইজতিহাদের ধারা বন্ধ করতে হবে। কারণ তার অসংলগ্ন মতসমূহ থেকে মনে হচ্ছে, —আল্লাহ না করুন— তিনি এমন একটি নতুন দল তৈরির প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন, যা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ বিশেষত আকাবিরের মাসলাক (মত ও পথ) থেকে ভিন্ন হবে।”

এই পরিপত্র জারির পর থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন সময় একের পর এক উক্ত ওয়ায়েযের এমনসব ওয়াজ পৌঁছতে থাকে, যা পড়ে নিঃসংকোচে লেখা যায়— তার আচরণ সংশোধনমুখিতার পরিবর্তে গলত ইজতেহাদ, দ্বীন-শরীয়তের বিষয়ে অপব্যাখ্যা এবং নিজের মনগড়া মতাদর্শের ওপর অনড় অবস্থানের দিকেই অগ্রসর হচ্ছে।

ভুপালের উলামায়ে কেরামের পক্ষ হতে কিছুদিন আগে যে বিভিন্ন নতুন বয়ান প্রেরণ করা হয়েছে, (যাতে ১৩ মে ২০২৩ বাদ ফজরের বয়ানটিও রয়েছে), তাতে (ঐ ব্যক্তির চিন্তাধারা সম্পর্কে) দারুল উলূমের এই অবস্থান ও রায় বাস্তবসম্মত বলে প্রতীয়মান হয় যে, তার বিষয়টি এমন নয় যে, ঘটনাক্রমে কোনো বিষয়ে ভুল বয়ান করা হয়েছে। বরং মূল সমস্যা হল চিন্তার বক্রতা, ইলমের কমতি এবং অযোগ্যতা সত্ত্বেও ইজতেহাদ ও ইস্তিম্বাতের স্পর্ধা প্রদর্শন। যে কারণে অপব্যাখ্যা-বিকৃতির স্বতন্ত্র এক ধারা অব্যাহত রয়েছে।

আরও খতরনাক বিষয় হল, তার অনুসারীরা গলত চিন্তাধারার ওপর ভিত্তিহীন দলীল-প্রমাণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার করছে। এবং যেন দারুল উলূম ও তার খাদেমগণের ওপর অন্যায় অভিযোগ দায়েরের এক মিশন চালু করে রেখেছে। এখন পর্যন্ত এসব বিষয়ে (দারুল উলুমের পক্ষ হতে) দৃক্পাত করা হয়নি। কিন্তু যখন জুমহুর (উলামায়ে) উম্মতের বিরুদ্ধে অসত্য অজ্ঞতাপূর্ণ বিষয় জনসাধারণের মাঝে চর্চা হচ্ছে, আকাবিরের মত ও পথের সম্পূর্ণ ভুল উপস্থাপন হয়ে চলছে, ‘সীরাতে সাহাবা’-এর নামে খাইরুল কুরুন (উম্মতের সর্বোত্তম তিন যুগ)-এর ভুল ও মনগড়া নকশা জনমানুষের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে এবং মসজিদে মসজিদে এসব গোমরাহীপূর্ণ কথা প্রচার করা হচ্ছে, তখন উম্মতকে গোমরাহি থেকে বাঁচানোর জন্য সঠিক ও সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত পেশ করা অনিবার্য দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়।

প্রশ্নপত্রে ২৯ এপ্রিল ২০২৩ ঈ.-এর যে বয়ান উদ্ধৃত করা হয়েছে, তার বিশ্লেষণের পূর্বে এটা জানা থাকা জরুরি যে, দ্বীনী খেদমতে মশগুল ব্যক্তিবর্গ সম্পর্কে উক্ত ওয়ায়েয যে মত পেশ করেছেন, এটাই তার নতুন কিংবা প্রথমবার কৃত বিচ্যুতি নয়। দারুল উলূম দেওবন্দ এবং উলামায়ে হকের পক্ষ হতে আগেও এ বিষয়টি সম্পর্কে তাকে সতর্ক করা হয়েছে। এতদসত্ত্বেও তিনি উন্মুক্ত জলসায় নিজের পুরনো ভুল চিন্তাধারা কোনো না কোনো শিরোনামে অব্যাহতভাবে পুনারাবৃত্তি করেই যাচ্ছেন। কিন্তু এই বয়ান তার আগের বয়ানগুলোর তুলনায় আরও বেশি ভয়ংকর। এতে তিনি উলামা, মুহাদ্দিসীন, মাশায়েখ ও দ্বীনী মাদরাসায় প্রচলিত গণসহযোগিতা ভিত্তিক নেযামকে পরিষ্কার ভাষায় অসম্মানের চেষ্টা করেছেন।

এ কথা সুষ্পষ্ট, যে বিষয়গুলোকে ভিত্তি বানিয়ে উক্ত ওয়ায়েয দ্বীনী খেদমতে মশগুল একনিষ্ঠ ব্যক্তিদেরকে  ব্যবসা-বাণিজ্য ও রোজগারমূলক পেশা অবলম্বনে উৎসাহ দিয়েছেন এবং আম মানুষের সামনে বার্তা দিয়েছেন যে, তালেবে ইলম, শিক্ষকবৃন্দ এবং দ্বীনের খাদেমগণের রোজগার ও ভরণপোষণ সংশ্লিষ্ট বিদ্যমান কর্মপদ্ধতি সাহাবায়ে কেরামের সীরাত-বিরোধী— এই বার্তা সম্পূর্ণ গলত। যে বিষয়গুলোকে ভিত্তি বানিয়েছেন, তাও ভুল, সীরাতে সাহাবার যে শিরোনাম অবলম্বন করেছেন সেটাও অজ্ঞতাপ্রসূত।

সঠিক কথা হল, সাহাবায়ে কেরাম রা.-এর মাঝে যারা মুসলিম জনসাধারণকে দ্বীনী সেবা প্রদানে আত্মনিয়োগ করতেন, তাদের ভরণপোষণে নিয়মতান্ত্রিকভাবে আওয়ামী কাফালাত (গণপৃষ্ঠপোষকতা-ভিত্তিক ভাতা ব্যবস্থা) জারি ছিল। বাইতুল মাল থেকে তাদের জন্য ভাতা নির্ধারণ করা হত। দ্বীনের এমন খাদেমগণ তাদের খরচাদির জন্য বাইতুল মাল থেকে সম্মানি-ভাতা গ্রহণ করতেন। আল্লামা আইনী রাহ.-এর সুষ্পষ্ট বক্তব্য অনুযায়ী সাহাবায়ে কেরামের মাঝে এমন ব্যক্তিদের জন্য ভাতা জারির বিষয়ে যেন ইজমা (সর্বসম্মত ঐকমত্য) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাদের ব্যবসা না করে গণপৃষ্ঠপোষকতা-ভিত্তক ভাতা গ্রহণ করার মৌলিক কারণ এটাই ছিল যে, ব্যবসা-বাণিজ্য ও আয়-উপার্জনে গেলে দ্বীনী খেদমত যথাযথভাবে আদায়ের ক্ষেত্রে কমি সৃষ্টি হয়। এ বিষয়ে মুহাদ্দিসীন, ফুকাহায়ে কেরাম এবং সীরাত গ্রন্থকারদের পরিষ্কার বক্তব্যের পরিমাণ এত বেশি যে, তা গুণে শেষ করা মুশকিল। নমুনা হিসেবে কয়েকটিমাত্র উদ্ধৃতি পেশ করা হচ্ছে—

সর্বপ্রথম হযরত আবু বকর রা.-এর সে ঘটনা পুরো তুলে ধরা হচ্ছে, যে ঘটনাকে উক্ত ওয়ায়েয তার ভুল (বার্তা) আবিষ্কারের ভিত্তি বানিয়েছেন। এই ঘটনার ব্যাখ্যায় মুহাদ্দিসীনে কেরাম কী বলেছেন তার প্রতি দৃষ্টি দেওয়া দরকার। হায়াতুস সাহাবায় ঘটনার বিবরণ এমন—

رد أبي بكر الصديق رضي الله عنه المالَ

قصة ردِّه رضي الله عنه وظيفتَه من بيت المال

أخرج البيهقي عن الحسن أن أبا بكر الصديق رضي الله عنه خطب الناس فحمد الله وأثنى عليه ثم قال: إنَّ أكيسَ الكَيْس التقوى، فذكر الحديث، وفيه: فلما أصبح غدا إِلى السوق فقال له عمر رضي الله عنه: أين تريد؟ قال: السوق، قال: قد جاءك ما يشغلك عن السوق، قال: سبحان الله، يشغلني عن عيالي قال: نفرض بالمعروف؛ قال: ويحَ عمر إِني أخاف أن لا يسعني أن آكل من هذا المال شيئاً. قال: فأنفقَ في سنتين وبعض أخرى ثمانية آلاف درهم، فلما حضره الموت قال: قد كنت قلت لعمر: إني أخاف أن لا يسعَني أن آكل من هذا المال شيئاً، فغلبني؛ فإذا أنا متُّ فخذوا من مالي ثمانية آلاف درهم وردوها في بيت المال قال: فلما أُتي بها عمر قال: رحم الله أبا بكر، لقد أتعب من بعده تعباً شديداً. (حياة الصحابة 2/516، مؤسسة الرسالة، للطباعة والنشر والتوزيع، بيروت، لبنان)

এ ঘটনা হাদীস ও সীরাতের বিভিন্ন কিতাবে কিছু শাব্দিক ভিন্নতার সাথে বর্ণিত আছে। এর সারসংক্ষেপ হল, হযরত আবু বকর রা. খেলাফত গ্রহণ করার পর সাহাবায়ে কেরাম একমত হয়ে বাইতুল মাল থেকে তাঁর জন্য ভাতা নির্ধারণ করে দেন এবং তিনি সেই ভাতা কবুল করেন। প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আব্দুল হাই কাত্তানী রাহ. তার বিখ্যাত কিতাব—

نظام الحكومة النبوية /التراتيب الإدارية

-এ দুটি পরিচ্ছেদ এনেছেন এভাবে—

الفصل الأول في أن لكلّ من شغل بشيء من أعمال المسلمين أخذ الرزق على شغله ذلك.

الفصل الرابع في أرزاق الخلفاء بعده صلى الله عليه وسلم ورضي عنهم.

(অর্থাৎ প্রথম পরিচ্ছেদ: মুসলমানদের জাতীয় কোনো দায়িত্বে যিনি নিয়োজিত থাকবেন, তিনি তার কাজের ওপর ভাতা লাভের অধিকারী হবেন। চতুর্থ পরিচ্ছেদ:  নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরবর্তী খলিফগণের ভাতা)

উপরোক্ত শিরোনামের অধীনে হযরত আবু বকর রা.-এর আলোচ্য ঘটনা থেকে মুহাদ্দিস আব্দুল হাই কাত্তানী রাহ. প্রমাণ পেশ করেছেন যে, প্রত্যেক ঐ ব্যক্তি বাইতুল মাল থেকে ভাতার অধিকারী হবেন, যিনি মুসলমানদের ইজতিমায়ী দ্বীনী খেদমতে আত্মনিয়োগ করবেন।

হায়াতুস সাহাবায় বর্ণিত ঘটনার মূল উৎস গ্রন্থ ‘সুনানে বায়হাকী’ যদি খুলে দেখা হয়, তাহলে জানা যাবে, ঐ গ্রন্থের লেখক প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও ফকীহ ইমাম বায়হাকী রাহ. তাঁর কিতাবে হযরত আবু বকর রা.—এর ঘটনাটির ওপর শিরোনাম দিয়েছেন—

بَابُ مَا يُكْرَهُ لِلْقَاضِي مِنَ الشِّرَاءِ وَالْبَيْعِ وَالنَّظَرِ فِي النَّفَقَةِ عَلَى أَهْلِهِ وَفِي ضَيْعَتِهِ لِئَلَّا يَشْغَلَ فَهْمَهُ.

(বিচারকের জন্য ব্যবসার পেশায় লিপ্ত হওয়া… মাকরূহ, যাতে তার মন ও বোধ বিক্ষিপ্ত না হয়।)

আল্লামা আইনীসহ অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ এই ঘটনা থেকে দলীল দিয়ে মুসলমানদের জাতীয় দ্বীনী খেদমতে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের জন্য বাইতুল মাল থেকে ভাতা গ্রহণ করা এবং গণসহযোগিতা ভিত্তিক খোরপোশ গ্রহণের কথা লিখেছেন।

আল্লামা নাবুলুসী রাহ. شرح الطريقة المحمدية নামক গ্রন্থে কাযী খান রাহ. এবং আল্লামা ইবনে নুজাইম রাহ.-এর বক্তব্য এনেছেন— ‘যে ব্যক্তি কুরআন-সুন্নাহর তালীম এবং মুসলমানদের ইজতিমায়ী দ্বীনী খেদমতে নিজেকে ব্যস্ত রাখবে, সে ধনী হলেও বাইতুল মাল থেকে ভাতা লাভের অধিকারী হবে।’

আমাদের আকাবিরের মাঝে হযরত থানবী রাহ. লিখেছেন, ‘আমাদের ফুকাহায়ে কেরাম লিখেছেন, কাযী যদি বড় ধনীও হয়, তবু তার ভাতা গ্রহণ করা উচিত। কারণ কোনো কাযী যদি ভাতা না নেন, (আর উদাহরণস্বরূপ) দশ বছর পর্যন্ত তিনি বহাল থাকেন, তখন তার পর কোনো দরিদ্র ব্যক্তি কাযী হয়ে আসলে বন্ধ ভাতা নতুন করে জারি করা মুশকিল হয়ে যাবে।

সুবহানাল্লাহ! ফুকাহায়ে কেরামের সমঝ কত গভীর! এঁরা ছিলেন দূরদৃষ্টির অধিকারী।’ (আলইলমু ওয়াল উলামা, দা‘আওয়াতে আব্দিয়্যাত (৩/৩১)-এর বরাতে, এদারায়ে ইফাদাতে আশরাফিয়া, লখনৌ)

শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া কুদ্দিসা সির্রুহু ‘ফাযায়েলে তিজারত’ গ্রন্থে আলোচ্য ঘটনা উল্লেখের পর শরহে বুখারীর সূত্রে লিখেছেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলমানদের স্বার্থে কোনো কাজে আত্মনিয়োগ করবে, যেমন কাযী, মুফতী, মুদাররিস তাদের বিধানও এমন হওয়া দরকার। (ফাযায়েলে তিজারত, পৃ. ৬৭, মাকতাবাতুশ শায়খ, করাচী)

লক্ষ করুন, আল্লামা আইনী রাহ., আল্লামা কাত্তানী রাহ. এবং হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া রাহ.-সহ অন্যান্য হাদীসবিশারদ এই ঘটনা থেকে মুসলিম জনসাধারণের দ্বীনী কাজে আত্মনিয়োগকারীদের জন্য বাইতুল মাল থেকে ভাতা গ্রহণ এবং গণসহযোগিতা ভিত্তিক পৃষ্ঠপোষকতা কবুল করার কথা লিখেছেন। ইমাম বায়হাকী রাহ. কাযা তথা বিচারকার্যের মতো দ্বীনী খেদমতে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য একনিষ্ঠতা বিনষ্টের আশংকায় তেজারতের পেশা গ্রহণ করাকে মাকরূহ আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু উক্ত ওয়ায়েয তাদের বিপরীতে একই ঘটনা উল্লেখ করে দ্বীনের খাদেমগণের জন্য ব্যবসা করাকে জরুরি এবং সহায়ক সাব্যস্ত করছেন। ব্যবসা ছেড়ে দ্বীনী কাজে ব্যস্ত হওয়াকে ‘নাকেস মোজাহাদা’ বলে ভাবছেন। দ্বীনের খাদেমগণকে সীরাতে সাহাবা-বিরোধী এবং তার মনগড়া সীরাতকে আযীমতের দাওয়াত বলে মনে করছেন!

ببيں تفاوت رہ  از کجا است تا بہ کجا

আর হায়াতুস সাহাবায় হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ ইউসুফ কান্দলবি রাহ. এই ঘটনা যে অধ্যায়ে এনেছেন, তার উদ্দেশ্য সাহাবায়ে কেরামের যুহদ ও দুনিয়াবিমুখতা বয়ান করা। অর্থাৎ হযরত আবু বকর রা. খেলাফতের কাজে মশগুল হওয়ার কারণে ঐ তেজারত ছেড়ে দিয়েছেন, যার মাধ্যমে স্বাচ্ছন্দ্যে তাঁর খরচাদি পূরণ হচ্ছিল। কিন্তু তিনি বাইতুল মালের যৎসামান্য ভাতার ওপর সীমাবদ্ধ থেকেছেন। এমনকি ইন্তেকালের পূর্বে বাইতুল মাল থেকে নেওয়া ভাতা সমপরিমাণ সম্পদ ফেরত দেওয়ার ওসিয়ত করে গিয়েছেন। এই ফেরত দেওয়া ছিল তাঁর অতি উচ্চ পর্যায়ের যুহদ ও তাকওয়ার বহিঃপ্রকাশ।

শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া রাহ.-ও ফাযায়েলে আমালে এ ঘটনা সাহাবায়ে কেরামের যুহদ প্রসঙ্গে এনেছেন। (ফাযায়েলে আমাল, হেকায়াতে সাহাবা, পৃ. ৫৭, তৃতীয় অধ্যায় : সাহাবায়ে কেরামের যুহদ ও দারিদ্র্য প্রসঙ্গ, বাইতুল মাল থেকে হযরত আবু বকর রা.-এর ভাতা গ্রহণ)

বিষয়টি পরিষ্কার হওয়ার জন্য এতটুকু আলোচনা যথেষ্ট। তবুও খায়রুল কুরূনে দ্বীনী খেদমতে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের গণসহযোগিতা ভিত্তিক খোরপোশের এন্তেজাম বিষয়ে মুহাদ্দিসীন ও ফুকাহায়ে কেরামের আরো কিছু বক্তব্য তুলে ধরা সঙ্গত মনে হচ্ছে, যাতে আলোচ্য বিষয়ে আরো বেশি তৃপ্তি ও প্রসন্নতা লাভ হয়।

বুখারী শরীফে এসেছে, ‘শায়খাইন (হযরত আবু বকর ও উমর) রা. বাইতুল মাল থেকে ভাতা গ্রহণ করতেন। কাযী শুরাইহ রাহ. বেতন নিতেন। হযরত উমর রা.-এর নিকট হযরত আব্দুল্লাহ বিন সা‘দী রা. আগমন করলেন। হযরত উমর রা. তাকে বললেন, খবর পেলাম, তুমি সরকারি কাজ কর, কিন্তু যে বেতন দেওয়া হয় তা গ্রহণ কর না? তিনি বললেন, খবর সঠিক। জিজ্ঞেস করলেন, কেন গ্রহণ কর না? বললেন, আমার খরচাদি আমি নিজেই নির্বাহ করি। আমার ঘোড়া-গোলামসহ আরো সম্পদ আছে। আমি চাচ্ছি, আমার শ্রম মুসলমানদের খেদমতে নিয়োজিত করব। হযরত উমর রা. বললেন, এমন কর না। আমিও এমনটা চেয়েছিলাম; কিন্তু নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে নিষেধ করেছেন।’

ইমাম বুখারী রাহ. باب نفقة القيم للوقف -এর অধীনে হাদীস এনেছেন, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমার ওয়ারিশদের মাঝে আমার কোনো দীনার-দিরহাম বণ্টন করবে না। আমার রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে স্ত্রীদের খরচাদি ও আমার আমেল-কর্মকর্তাদের বেতনাদি দেয়ার পর যা বাঁচবে তা সাদাকা বলে গণ্য হবে।

এই হাদীসের ব্যাখ্যায় মোল্লা আলী কারী রাহ. মেরকাতে এবং শাইখুল হাদীস মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া রাহ. লামেউদ দারারীর পার্শ্বটীকায় উল্লেখ করেন, ‘উক্ত হাদীসে উদ্দেশ্য হল, ‘ফাই’ হিসেবে পাওয়া বনু নযীরের জমিন, ‘ছাহাম’ হিসেবে পাওয়া খায়বারের জমিন এবং খায়বার বিজয়ের পর ‘সুল্হ’ হিসেবে পাওয়া ‘ফাদাক’-এর জমিন। এই জমিনগুলো হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খরচাদি নির্বাহের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। আর হাদীসে উল্লিখিত আমেল-কর্মকর্তা দ্বারা উদ্দেশ্য মুসলমানদের খলীফা।’

বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাকার ইবনে বাত্তাল রাহ. مؤنة عاملي প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেহেতু নিজের রেখে যাওয়া সম্পত্তি ব্যয়ের একটি খাত হিসেবে আমেল তথা খলীফাতুল মুসলিমীনের কথা উল্লেখ করেছেন, যিনি মুসলমানদের ইজতিমায়ী খেদমতে নিয়োজিত থাকেন, তাই যে কোনো ব্যক্তি মুসলমানদের জাতীয় কল্যাণের কাজে আত্মনিয়োগ করবে, যেমন আলেম, কাযী, মুআযযিন প্রমুখও খলীফার মতো বাইতুল মাল থেকে ভাতার অধিকারী হবে।’

ইবনুল আছীর রাহ. তার সংকলিত ‘তারীখ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘হযরত উমর রা. মুসলমানদের সম্বোধন করে বলেন, তোমরা জানো, আমি একজন ব্যবসায়ী মানুষ। আমার পরিবারের খরচ ব্যবসার মাধ্যমে নির্বাহ হত; কিন্তু এখন আমি তোমাদের খেদমতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। সুতরাং বাইতুল মাল থেকে ভাতা নেয়ার বিষয়ে তোমাদের মতামত কী? হযরত আলী রা. বললেন, আমীরুল মুমিনীন! আপনার ও আপনার পরিবারের জন্য যতটা দরকার হয় আপনি গ্রহণ করুন। এ কথার ওপর সকল মুসলমান একমত হল। তখন হযরত উমর রা. বাইতুল মাল থেকে ভাতা নেওয়া আরম্ভ করলেন।’

ইমাম ইবনে জারীর তাবারী রাহ.-এর সূত্রে হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. লিখেছেন, ‘এই হাদীস থেকে পরিষ্কার বোঝা গেল, যিনিই মুসলমানদের ইজতিমায়ী কাজে মশগুল হবেন, তিনি বাইতুল মাল থেকে ভাতার হকদার হবেন।’

আবু দাউদ শরীফের হাশিয়ায় হযরত মাওলনা ফখরুল হাসান গাঙ্গুহী রাহ. লিখেছেন, ‘এই হাদীস থেকে জানা গেল, মুসলমানদের সাথে সংশ্লিষ্ট যে কোনো সামাজিক দ্বীনী খেদমতের জন্য বাইতুল মাল থেকে বেতন নেওয়া জায়েয। যেমন শিক্ষকতা, বিচারকার্য পরিচালনা ইত্যাদি। বরং বাইতুল মাল থেকে এ ধরনের কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের খোরপোশের ব্যবস্থা করা শাসকের ওপর জরুরি।’

‘আত ত্বরীকতুল মুহাম্মাদিয়্যাহ’ নামক প্রসিদ্ধ কিতাবে আল্লামা বারকাবি হানাফী এ বিষয়ে স্বতন্ত্র একটি পরিচ্ছেদই এনেছেন—

الفصل الثاني في التورع والتوقي من طعام أهل الوظائف من الأوقاف وبيت المال إلخ

এখানে তিনি বাইতুল মালের ভাতার ওপর সন্দেহ করে তা পরিহার করাকে জাহালাত বলে আখ্যায়িত করেছেন। খোলাফায়ে রাশেদীন বাইতুল মাল থেকে ভাতা নিতেন বলে পরিষ্কার উল্লেখ করার পর বলেন—

لا فرق بين الوقف وبيت المال وبين غيرهما من المكاسب في الحل والطيب، إذا روعي شرائط الشرع، ولا في الحرمة و الخبث، إذا لم تراع،  بل الأولان أشبه وأمثل في زماننا.

(অর্থাৎ বাইতুল মাল ও আওকাফ থেকে প্রাপ্ত ভাতা আর অন্যান্য উপায় থেকে লাভ করা উপার্জনে হালাল ও পবিত্র হওয়ার দিক থেকে কোনো পার্থক্য নেই, যদি তাতে শরীয়ত নির্ধারিত শর্তগুলো লক্ষ রাখা হয়।… বরং বাইতুল মাল ও আওকাফ থেকে প্রাপ্ত ভাতা আমাদের এ যামানায় বেশি ভালো।)

হাফেজ ইবনু আব্দিল বার রাহ. সনদসহ বর্ণনা করেন, ‘শামের শাসক হিসেবে হযরত মুআবিয়া রা.-কে হযরত উমর রা. বছরে দশ হাজার দীনার ভাতা প্রদান করতেন।’

ইমাম আবু ইউসুফ রাহ. ‘কিতাবুল খারাজ’-এ فصل في أرزاق القضاة পরিচ্ছেদে লিখেছেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলমানদের উমুমি কাজে মশগুল হবে, সে বাইতুল মাল থেকে সম্মানী লাভের অধিকারী হবে। এ কারণে সবসময় ইসলামী খলীফাগণের নিয়ম ছিল, তারা কাযীদের জন্য বাইতুল মাল থেকে বেতন ধার্য করে দিতেন।’

আল্লামা জামালুদ্দীন যায়লায়ী রাহ. ‘নাসবুর রায়াহ’ কিতাবে হযরত উমর রা.-এর নিয়ম বর্ণনা করেন, ‘তিনি দ্বীনী শিক্ষকদের জন্য ভাতা নির্ধারণ করে দিতেন।’

বাস্তবতা হল, যেমনটা আল্লামা ফখরুদ্দীন যায়লায়ী রাহ. ‘তাবয়ীনুল হাকায়েক’ নামক কিতাবে লিখেছেন, ‘কাযীকে বাইতুল মাল থেকে ভাতা প্রদানের কারণ হল, তিনি মুসলমানদের ইজতিমায়ী দ্বীনী কাজে ‘আটক’ থাকেন। আর ‘আটক থাকাটা’ খোরপোশ প্রাপ্তির কারণ। সাহাবা ও তাবেয়ীনে কেরামের যুগে বাইতুল মাল থেকে ভাতা গ্রহণের নিয়ম ছিল। খোদ হযরত আবু বকর রা. ও তৎপরবর্তী খলীফাগণ জরুরত পরিমাণ ভাতা গ্রহণ করতেন। বোঝা গেল, এটা ইজমায়ী মাসআলা।’

হাফেজ সাখাবী রাহ. লিখেছেন, ‘সালাফে সালেহীনের কেউ কেউ শুধু এই কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন যে, তার আয় দ্বারা ঐসকল উলামা ও মুহাদ্দিসীনে কেরামের ওপর খরচ করবেন, যারা ইলমে দ্বীনের প্রচার-প্রসারের কাজে নিজের জীবনকে অন্য সব ব্যস্ততা থেকে সরিয়ে রেখেছেন। রোজগারের জন্য কোনো কাজের ফুরসত যাদের নেই। ফুজাইল ইবনে ইয়াজকে লক্ষ করে আব্দুল্লাহ ইবনে মোবারক রাহ. বলেন, তুমি আর তোমার সাথীরা অর্থাৎ সুফিয়ান ছাওরী ও সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা প্রমুখ না থাকলে (অর্থাৎ তোমাদের নিয়মিত হাদিয়া প্রদানের নিয়ত না হলে) আমি ব্যবসা-বাণিজ্য করতাম না।’

‘তারীখে দিমাশক’-এ ইবনে আসাকির রাহ. (৫৭১ হি.) সনদসহ লিখেছেন, ‘তিনজন শিক্ষক মদীনায় শিশুদেরকে দ্বীনী তালীম প্রদান করতেন। হযরত উমর রা. তাদের একেকজনকে মাসে পনের দিরহাম করে প্রদান করতেন।’

‘কিতাবুল আমওয়াল’-এর باب الفرض على تعليم القرآن والعلم শীর্ষক অধ্যায়ে আবু উবায়েদ কাসেম ইবনে সাল্লাম রাহ. লিখেছেন, ‘হযরত উমর রা. কতক প্রশাসককে পত্র মারফত লেখেন যে, তোমরা কুরআন শেখার জন্য লোকদের ভাতা প্রদান করবে।’

ইসলামী ঐতিহাসিক কাযী আতহার মোবারকপুরী রাহ. লিখেছেন, ‘নবীযুগে স্থানীয় এবং বহিরাগত উভয় ধরনের তালেবে ইলমের থাকা-খাওয়ার নিয়মিত ব্যবস্থা ছিল। স্থানীয় তালেবে ইলম— ইসলামের মেহমান, আসহাবুস সুফ্ফা এবং অন্যান্য দরিদ্র সাহাবী মসজিদে নববীতে থাকতেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও অবস্থাপন্ন সাহাবীরা তাঁদেরকে ঘরে নিয়ে মেহমানদারি করতেন। মসজিদেও তাদের জন্য খেজুর-পানির ব্যবস্থা রাখতেন। এর ব্যবস্থাপনায় ছিলেন হযরত আবু হুরায়রা রা. ও হযরত মুআয ইবনে জাবাল রা.। আর বহিরাগত তালেবে ইলম— মদীনার বাইরে থেকে আগত ব্যক্তি এবং বিভিন্ন ওয়াফদ সাধারণত রামালা বিনতে হারেসের বাড়িতে উঠতেন। এটা ‘দারুয যিয়াফাহ’ নামে প্রসিদ্ধ ছিল। এখানে ছয়-সাত শত লোকের অবস্থানের অবকাশ হত। এঁদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাপনায় নিযুক্ত ছিলেন হযরত বেলাল রা.। অন্য জায়গায়ও কতক ব্যক্তি ও ওয়াফদকে থাকতে দেয়া হত।’ (খায়রুল কুরূন কী দ্বীনী দরসগাহেঁ আওর উনকা নেজামে তালীম ওয়া তারবিয়াত, পৃ. ১৪২)

কিতাবের আরেক জায়গায় তিনি লেখেন, ‘যখন মক্তবের ব্যাপক প্রচলন হয়ে গেল, তখন শহরে, গ্রামে, বিরান মরুতে এবং গোত্রে গোত্রে ব্যক্তি কেন্দ্রিক মক্তব চালু হয়ে গেল। আর সব শ্রেণীর মানুষ নিজেদের মতো করে প্রয়োজন অনুযায়ী শিশুদের শিক্ষাদান ও শিক্ষকদের বেতন-ভাতার ব্যবস্থা করত।’ (খায়রুল কুরূন কী দ্বীনী দরসগাহেঁ আওর উনকা নেজামে তালীম ওয়া তারবিয়াত)

দ্বীনী খেদমতের সাথে ভাতা গ্রহণ এবং ব্যবসা না করার বিষয়ে হযরত আবু বকর রা., হযরত উমর রা. এবং অন্যান্য সাহাবায়ে কেরামের যে আমল রয়েছে আর এক্ষেত্রে ফুকাহায়ে কেরাম যা কিছু বলেছেন, তার আলোকে হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রাহ. তাঁর সংস্কারমূলক কিতাব ‘ইসলাহে ইনকেলাবে উম্মত’-এ এ বিষয়ে বিস্তারিত দলীলসমৃদ্ধ আলোচনা করেছেন। সারসংক্ষেপ হল—

‘উলামা-তলাবা এবং দ্বীনী খেদমতে মশগুল ব্যক্তিবর্গের আর্থিক খেদমত করা মুসলমানদের ওপর ওয়াজিব এবং জরুরি। এটা ‘ওয়াজিব নাফাকা’-এর গুরুত্বপূর্ণ প্রকার। সাধারণত লোকজনের মনোযোগ এদিকে থাকে না। ফুকাহায়ে কেরাম বলেন, নাফাকা (ভরণপোষণ) হল কারো কাজে আটক থাকার প্রতিদান। যেমন কাযীর নাফাকা। একজন কাযী যেহেতু জনসাধারণের খেদমতে আটক, তাই সকল মুসলমানের মাল থেকে বাইতুল মালের মাধ্যমে তার ভরণপোষণের খরচ নির্বাহ হয়। অনুরূপভাবে উলামা-তলাবার নাফাকাও সাধারণ মুসলমানের ওপর ওয়াজিব। কারণ তারা জাতির দ্বীনী খেদমতে নিয়োজিত। এর যৌক্তিক উদাহরণ হল, যদি পুরো জাতির কেউই ডাক্তারি না শেখে, যুক্তির দাবি হল সবাই মিলে কিছু লোককে এই শাস্ত্র অধ্যয়নে লাগিয়ে দেবে এবং তাদের খোরপোশের দায়িত্ব নেবে। অন্যথায় পুরো জাতি সমস্যায় পড়বে।

যতদিন বাইতুল মালের ব্যবস্থাপনা ছিল, এ নাফাকা বাইতুল মাল থেকে (উলামা-তলাবার নিকট) পৌঁছে যেত। কিন্তু এখন এই এক ছুরত বাকি আছে যে, এ খেদমত সরাসরি মুসলমান জনসাধারণ করবে; হয়ত মাদরাসার মাধ্যমে দেবে অথবা নিজেরা সরাসরি দেবে। কুরআন মাজীদের আয়াত—

لِلْفُقَرَآءِ الَّذِيْنَ اُحْصِرُوْا فِيْ سَبِيْلِ اللهِ لَا يَسْتَطِيْعُوْنَ ضَرْبًا فِي الْاَرْضِ .

আমাদের এই বক্তব্যের সুষ্পষ্ট প্রমাণ। কারণ এখানে ل হরফটি অধিকার বোঝাচ্ছে।  اُحْصِرُوْا আটক থাকা প্রকাশ করছে। فِيْ سَبِيْلِ اللهِ -এর তাফসীর ‘তালেবে ইলম’ বলে বর্ণিত আছে। لَا يَسْتَطِيْعُوْنَ ضَرْبًا  দ্বারা আয়-উপার্জনের ফুরসত না থাকার প্রতি ইশারা করা হয়েছে। এ সমস্ত দলীল থাকার পরও উলামা-তলাবাকে এই প্রশ্ন করা আশ্চর্যজনক যে, তোমরা জীবিকার কী ব্যবস্থা করেছ? এই প্রশ্ন করার হক তো তাদের নয়, উলামা-তলাবার!

এই বিশ্লেষণ মোতাবেক আলোচ্য মাসআলায় শাফেয়ী মাযহাবের বক্তব্য অনুযায়ী ফতোয়া দেওয়ার কোনো জরুরত নেই। কারণ এটা তো কওমের ওপর ওয়াজিব নাফাকা। হানাফীদের নিকট এটা আটক থাকার প্রতিদান। আর নাফাকার পরিমাণ ঠিক করে দেওয়া হয় মনোমালিন্য বিদূরণের জন্য, উজরত হওয়ার কারণে নয়।

এখন এ সংশয় থাকা গ্রহণযোগ্য নয় যে, উলামা-তলাবা কেন রোজগারের জন্য সময় বের করে না!

যে কামাই রোজগারে যায়, সে ওই পরিমাণ খেদমত করতে পারে না, রোজগারের ব্যস্ততা থেকে মুক্ত থাকলে যতটা পারে। এটা অভিজ্ঞতা দ্বারা প্রমাণিত। আর অভিজ্ঞতার আলোকে প্রমাণিত বিষয়ে তর্ক সাজে না।’

কুরআনের আয়াতে লক্ষ করুন—  لَا يَسْتَطِيْعُوْنَ বলা হয়েছে। এরা তো প্রতিবন্ধী নয়, বরং চূড়ান্ত মাত্রায় দ্বীনী খেদমতে মশগুল।’

(ইসলাহে ইনকেলাবে উম্মত ২/১৯০-১৯৩, মাকতাবা যাকারিয়া, দেওবন্দ

হযরত থানবী রাহ.-এর পূর্ণ বক্তব্য উল্লিখিত সূত্রে দেখুন)

হযরত থানবী রাহ. এক বয়ানে আরও বলেন, ‘ এ আয়াত—

لِلْفُقَرَآءِ الَّذِيْنَ اُحْصِرُوْا فِيْ سَبِيْلِ اللهِ لَا يَسْتَطِيْعُوْنَ ضَرْبًا فِي الْاَرْضِ .

থেকে জানা যায়, কামাই রোজগারের ধান্দায় এমন মানুষদের একেবারেই যাওয়া উচিত নয়। لَا يَسْتَطِيْعُوْنَ ضَرْبًا فِي الْاَرْضِ হল এই দাবির সপক্ষে প্রমাণ। আর এর দ্বারা এই খটকাও দূর হয়ে যায় যে, আলেমগণ দুনিয়াবি কাজে প্রতিবন্ধীর মতো। প্রমাণ হয়ে গেল, এই অর্থে প্রতিবন্ধী হওয়া জরুরি। এর রহস্য হল, একজনের দ্বারা দুই কাজ একসাথে হয় না। বিশেষত ঐ কাজ, যাতে সবসময় লেগে থাকতে হয়।’ [আলইলমু ওয়াল উলামা, পৃ. ১৬১, ‘হুকুকুল ইলম’ (পৃ. ১৫)-এর বরাতে]

রাজ কোষাগার থেকে প্রাপ্ত রাজার বেতন আর গণঅনুদান থেকে দেয়া শিক্ষকগণের ভাতার মিল সম্পর্কে হযরত থানবী রাহ. আলোকপাত করে বলেন—

‘কোষাগার থেকে বাদশাকে যে ভাতা দেওয়া হয়, তা এজন্য যে, তিনি জনতার কাজে অবরুদ্ধ। বাদশাহ তিনি, যাকে পুরো কওম মিলে শাসক বানায় এবং তাকে বাইতুল মাল থেকে বেতন দেয়। এখন লক্ষ করার বিষয় হল, কোষাগার কীসের নাম। এর তত্ত্ব-হাকীকত বলে দিচ্ছি। পুরো জাতির কাছ থেকে যে চাঁদা-ট্যাক্স একত্রিত করা হয় —যায়েদের এক পয়সা, আমরের এক পয়সা, বকরের এক পয়সা— এ সব পয়সা কুঠিতে জমা করা হয়। এর নামই কোষাগার। এর আসল কথা চাঁদা, জাতির দেওয়া চাঁদা। এখান থেকেই আসে বাদশার ভাতা। শুধু ‘কোষাগার’-শব্দের কারণে মান বেড়ে গেছে, লোকে বলে রাজকোষাগার! কিন্তু গণচাঁদাই তো এর আসল হাকীকত! সুতরাং ঐ ফান্ডেরও হাকীকত এই, যেখান থেকে মৌলবীদের ভাতা আসে!’ (আলইলমু ওয়াল উলামা, পৃ. ১৬৯-১৭০, ‘আততাবলীগ’ (২/৭৪)-এর বরাতে, এদারায়ে ইফাদাতে আশরাফিয়া, লখনৌ)

এ সমস্ত ভাষ্য থেকে এটা পরিষ্কার যে, দ্বীনী খেদমতে মশগুল মানুষের ভরণপোষণের দায়িত্ব মুসলিম জনসাধারণের ওপর। এই ধরনের নাফাকা গ্রহণ করা কেবল জায়েযই নয়, বরং শরীয়তের রুচি-প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং (আগের মতো) হাল যামানায়ও মুস্তাহসান বা মুস্তাহাব। এটা সাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে সালেহীনের সীরাত দ্বারা প্রমাণিত। তেমনি আমাদের আকাবির গণঅনুদান-ভিত্তক মজবুত, সুগঠিত ও ফলপ্রসূ শিক্ষাধারা চালু রাখার পেছনে প্রাণান্তকর চেষ্টা করে গেছেন। হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ কাসেম নানুতবী রাহ. দারুল উলূম দেওবন্দের জন্য যে ‘মূলনীতি অষ্টক’ প্রণয়ন করেছেন, তার প্রথম ও দ্বিতীয় ধারায় অধিকহারে অনুদান আহরণের ফিকির, তালেবে ইলমদের থাকা-খাওয়ার উন্নত ব্যবস্থাপনার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেয়ার কথা আছে, যাতে দ্বীনের হেফাজত ও প্রচার-প্রসারের কাজ এক মনে এক ধ্যানে আঞ্জাম দেয়া যায়।

এজন্য দ্বীনী খেদমতে মশগুল ব্যক্তিগণ নিজের খরচ নিজে বহন করে মানুষ থেকে অমুখাপেক্ষিতা লাভ এবং মেহনত মোজাহাদা পূর্ণাঙ্গ করার প্রসঙ্গে উক্ত ওয়ায়েয তাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য করার যে দাওয়াত দিয়েছেন, সেটা তার সীরাত বিষয়ে অজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া কিছুই নয়। বরং দ্বীনী খেদমত এখতিয়ারের পর নিমগ্নতা ও একনিষ্ঠতা রক্ষার জন্য সম্মানী বা ভাতা কবুল করা ব্যবসা-বাণিজ্য করার চেয়ে উত্তম। যদি ইখলাসের সাথে কেবল আল্লাহর জন্য দ্বীনী খেদমত করা হয়, তাহলে আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী ও হযরত থানবী রাহ.-এর ভাষ্যমতে দ্বিগুণ সওয়াব হবে। প্রথমত দ্বীনী ইলম প্রচারের সওয়াব। দ্বিতীয়ত পরিবারের জন্য উপার্জনের সওয়াব। (দেখুন : ফতোয়ায়ে শামী, বাবুল আযান; আখতারী বেহেশতী জেওর, একাদশ অধ্যায়, পৃ. ১৩৮)

বরং বিশেষ কিছু কারণে জরুরত না থাকলেও বেতন গ্রহণ করা মুস্তাহসান (উত্তম)। ‘হেদায়া’ গ্রন্থকার ধনী কাযীর জন্যও ভাতা গ্রহণের বিশেষ কল্যাণের দিক উল্লেখ করেছেন। (আলইলমু ওয়াল উলামা, পৃ. ১৭২, আলকালামুল হাসান (পৃ. ২৩)-এর বরাতে, এদারায়ে ইফাদাতে আশরাফিয়া লখনৌ)

ফাযায়েলে তিজারতে শাইখুল হাদীস মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া রাহ. লিখেছেন, ‘আমি আগেও লিখেছি, আমার মতে কেবল পেশা হিসেবে ব্যবসা উত্তম। কারণ ব্যবসার মাঝে সময় নিজের মালিকানায় থাকে। তাই (সময়ে সময়ে) দ্বীনী শিক্ষা দিতে পারে, নিতে পারে এবং তাবলীগ-ইফতা ইত্যাদির কাজ করতে পারে। নতুবা চাকরি যদি দ্বীনী কাজের হয়, তবে তা ব্যবসা থেকেও উত্তম। কারণ এটা বাস্তবেই সরাসরি দ্বীনী কাজ। শর্ত হল, দ্বীনী কাজই তার লক্ষ্য হবে; বেতন হবে মজবুরি-অপারগতা জনিত বিষয়। আমার অধিকাংশ আকাবিরে দেওবন্দের অবস্থা এমনই ছিল। দ্বীনী কাজকে আসল মনে করবে আর বেতনকে আল্লাহ তাআলার দান ভাববে। কোথাও শিক্ষকতা, ইফতা ইত্যাদিতে কর্মরত অবস্থায় কেবল বাড়তি বেতনের আশায় অন্যত্র যাবে না।’

দ্বীনী খেদমতে নিয়োজিত থাকাকালে রোজগারের জন্য ব্যবসা ইত্যাদিকে পেশা হিসেবে নেয়া মুহাদ্দিসীন, ফুকাহা এবং আমাদের আকাবিরের অভিজ্ঞতা মতে দ্বীনী খেদমতের জন্য ক্ষতিকর।

শাইখুল হাদীস মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া রাহ. লিখেছেন—

‘কয়েক বছর যাবৎ আমি মাদরাসা কর্তৃপক্ষকে মশওয়ারা দিয়ে যাচ্ছি যে, বিনা বেতনের কোনো শিক্ষক যেন না নেয়া হয়। আমার নিজের প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতা হল, মাজাহিরুল উলূমে আমি প্রথমদিকে কোনো কোনো ব্যক্তিকে ‘মুঈন মুদাররিস’ পদে এক-দুই সবক পড়াতে দিয়ে বাকি সময় ব্যবসা করার পরামর্শ দিতাম। কিন্তু লক্ষ করতাম, এক বছরে শিক্ষকতার প্রতি তার মনোযোগ বাড়ার পরিবর্তে কমে যেত, সে ব্যবসায় ডুবে যেত। আস্তে আস্তে দ্বীনী কাজ ছুটেই যেত! আর অবৈতনিক শিক্ষক যতটা অমনোযোগী হয়, বেতনভুক্ত শিক্ষক তেমন হয় না।… এজন্য আমাদের আকাবিরের নিয়ম এমনই ছিল। হযরত গাঙ্গুহী রাহ. প্রথমদিকে দশ রুপি বেতনে সাহারানপুরে শিশুদের পড়াতেন। হযরত নানুতবী রাহ. হাদীস পড়ানো এবং কিতাব তাসহীহের কাজে বেতন নিতেন। হযরত থানবী রাহ.-এর ঘটনা প্রসিদ্ধ। কানপুরের মাদরাসায় তিনি বেতন নিয়ে শিক্ষকতা করেছেন।’ (ফাযায়েলে তিজারত, পৃ. ৫২-৬২, মাকতাবাতুশ শায়খ, করাচী)

উপরন্তু আলোচ্য ব্যক্তি উলামা-তলাবাকে উদ্দেশ্য করে তাদের জীবিকার বিষয়ে যে ভিত্তিতে যে প্রস্তাব রেখেছেন, আফসোসের বিষয় হল, সেই প্রস্তাবই বহু আগ থেকে প্রগতিশীলরা করে আসছে। এ সম্পর্কে হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ তকী উসমানী সাহেব দামাত বারাকাতুহুম লিখেছেন,

‘অনেক ভদ্রলোক দ্বীনী মাদরাসার সহমর্মী ও কল্যাণকামী হয়ে পরামর্শ দেয়, মাদরাসায় হস্তশিল্প এবং অন্যান্য টেকনিক্যাল কাজ শেখানো হোক। তাহলে যারা এখান থেকে লেখাপড়া শেষ করবে, তারা অর্থনৈতিকভাবে সমাজের ওপর বোঝা না হয়ে এবং অন্যদের অধীন না হয়ে জীবিকা নিজ হাতে কামাই করবে আর বিনিময় ছাড়া দ্বীনী খেদমত আঞ্জাম দিতে পারবে। এ পরামর্শর্ যত নেক নিয়তের সাথে দেওয়া হোক আর বাহ্যিকভাবে যত আকর্ষণীয় মনে হোক, এটা বাস্তবতা বিবর্জিত এবং আমলে নেয়ার অযোগ্য।

প্রথম কথা হল, দ্বীনী মাদরাসার উদ্দেশ্য হল কুরআন-সুন্নাহর বিভিন্ন শাখায় প্রজ্ঞাবান আলেম তৈরি করা। এই ইলমগুলোর সঠিক খেদমতের জন্য পুরো সময়ের বিনিয়োগ অপরিহার্য। আজকাল জীবনযাত্রা অনেক জটিল হয়ে গেছে। এখন অভিজ্ঞতা হল, টেকনিক্যাল কাজে লেগে গেলে ইলমী খেদমত কেবল এক স্বপ্নই থেকে যায়। সারা জীবনেও আর সে স্বপ্ন পূরণ হয় না। কিছু ছাত্র দ্বীনী ইলমের সাথে হাতের কাজ শিখেছে। কিন্তু অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে এবং এতে কোনো ব্যতিক্রমও পরিলক্ষিত হয়নি যে, লেখাপড়া শেষে যখন তারা দ্বীনী খেদমতে অত্মনিয়োগ করেছে, তখন আর হস্তশিল্পের দিকে নজর দেওয়ার সুযোগ হয়নি। আর যে হস্তশিল্পের মাধ্যমে জীবিকা অর্জনের কাজে নেমেছে তার আর ইলমে দ্বীনের সাথে সম্পর্ক রাখা সম্ভব হয়নি। সুতরাং যে মাদরাসা উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন উলামা তৈরির উদ্দেশ্যে কায়েম হয়েছে, তার জন্য ইলমে দ্বীনের সাথে সাথে টেকনিক্যাল কাজ শেখানোর ব্যবস্থা করা সম্ভবও নয়, উচিতও নয়।

দ্বিতীয়ত এটা বিস্ময়কর চিন্তা যে, সমাজের দ্বীনী জরুরত পূরণ করে বেতন-ভাতা নিলে সমাজের জন্য বোঝা হবে এবং পরাধীন হয়ে যাবে! কারণ সকল শাস্ত্রীয় বিদ্যার ক্ষেত্রে নিয়ম হল, যে ব্যক্তি কোনো শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জন করে আর বিদ্যার সেই শাখায় সমাজসেবা করে, তার ভরণপোষণ সেই শাখা থেকেই হয়। সুতরাং আলেমগণ দ্বীনী খেদমত আঞ্জাম দিয়ে বেতন-ভাতা গ্রহণ করলে তাতে সমাজের বোঝা হওয়া বা পরাধীন হওয়ার প্রশ্ন আসে না। এটা বরং সমাজব্যবস্থার অপরিহার্য অনুষঙ্গ। এর ওপরই পুরো মানব সমাজের বুনিয়াদ। যদি কোনো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অর্থনীতিবিদ, বিজ্ঞানী আপন আপন কর্মক্ষেত্রে সমাজসেবা করে এবং তার বিনিময়ে সমাজ থেকে তার রোজগার হাসিল হয়, তাহলে এটা তার ওপর কোনো দয়া নয় এবং এ কারণে তাকে বোঝা বা পরাধীন ভাবার সুযোগ নেই।

এখন প্রশ্ন হল, দ্বীনী ইলমের খেদমত সমাজের জরুরি প্রয়োজন নয় কি? মুসলিম সমাজের জন্য এমন আলেমের কি প্রয়োজন নেই, যিনি তাদের দ্বীনী জরুরত পূরণ করবেন, নতুন নতুন পরিস্থিতিতে দ্বীনী নির্দেশনা প্রদান করবেন? তাদের সন্তানদের দ্বীন শেখাবেন? তাদের দ্বীনী ভবিষ্যত সুরক্ষার জন্য জীবন কোরবান করবেন? দুশমনের হামলা থেকে দ্বীনকে রক্ষা করবেন? এটা তো একটি মুসলিম সমাজের সর্বাগ্রে পূরণীয় জরুরত; কে এটা অস্বীকার করবে?

এসমস্ত খেদমত আঞ্জাম দেয়ার ক্ষেত্রে আহলে ইলমকে রোজগারের চিন্তা থেকে মুক্ত করার জন্য যদি সমাজ তার দায়িত্ব পূরণ করে, তবে সেটা কোনো দয়া নয়। সুতরাং এই ধারণা কোত্থেকে এল, তারা সমাজের জন্য বোঝা এবং পরাধীন, তাই তাদের রোজগারের জন্য ভিন্নভাবে হাতের কাজ শিখতে হবে!’ (হামারা তালীমী নেযাম, পৃ. ৮৮-৯০, যমযম বুকডিপো, দেওবন্দ)

মোটকথা

উপরোক্ত বিবরণ থেকে একথা সুষ্পষ্ট, হযরত আবু বকর রা.—এর ঘটনা থেকে আলোচ্য ব্যক্তি বেকার ইজতেহাদ করে যে সমস্ত কথাবার্তার অবতারণা করেছেন, তা সম্পূর্ণই গলত, হায়াতুস সাহাবার শিরোনাম এবং মূল ঘটনার সাথে যার কোনো সম্পর্ক নেই।

এ দাবি কতটা ধৃষ্টতাপূর্ণ— ‘উম্মতের সমস্ত আকাবির বহু শতাব্দী যাবৎ সাহাবায়ে কেরামের তরীকা থেকে বিচ্যুত হয়ে আছেন, আরামপ্রিয়তায় নিমজ্জিত রয়েছেন, অপব্যাখ্যা করে শরীয়ত সমর্থিত নয়, এমন জিনিসকে শরীয়তের অংশ বানিয়ে রেখেছেন! শতাব্দীকাল ধরে পুরো উম্মত ‘তাবিল-পূজারী’ আলেমদের খপ্পরে পড়ে আছে। আযীমতের অধিকারী উলামার ধারা বন্ধ হয়ে গেছে, এখনো বন্ধ আছে!’

আমাদের আকাবির ও আসলাফের ওপর এর চেয়ে বড় তোহমত আর কী হতে পারে!

উম্মতের আলেমগণের ওপর এটা কত জঘন্য হামলা— ‘তারা সবাই রুখসতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। বরং ঐ ব্যক্তির ভাষায় তারা আরামপ্রিয়তা ও তাবিল-প্রিয়তায় এতটাই মগ্ন হয়ে গিয়েছেন যে, হক কথা এখন আর তাদের বরদাশত হয় না! তারা ঐ হকের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যান।’

আলোচ্য দাবির পরিণাম নিয়েও চিন্তা করা যাক, যে সমস্ত সাধারণ মানুষ ঐ ব্যক্তির সব কথাকে চূড়ান্ত মনে করে, এ বয়ান শোনার পর তারা শুধু ঐ আলেমদের কদর করবে, যারা ব্যবসা-বাণিজ্যে লিপ্ত। আর যারা তাদের মনগড়া মানদণ্ডে পড়বে না, তারা সবাই অনাস্থার পাত্র!

আলোচ্য ব্যক্তির দাবি— ‘দ্বীনী খেদমতের সাথে বেতন-ভাতা নেওয়া হলে মোজাহাদা নাকেস হয়ে যায়’। তার এই আক্রমণাত্মক দাবির মুখে তো খোদ হযরত আবু বকর রা., হযরত উমর রা.-এর মতো আযীমতের পাহাড় ব্যক্তিগণ পড়ে যাচ্ছেন যে, (বাইতুল মালের মাধ্যমে) গণপৃষ্ঠপোষকতা গ্রহণ করার কারণে নাউযু বিল্লাহ তাদের মোজাহাদাও নাকেস ছিল। অথচ তেজারত ছেড়ে মামুলি ভাতায় তুষ্ট থেকে সর্বক্ষণ মুসলমানদের জাতীয় কাজে নিমগ্ন থাকাই আযীমতের বড় নিদর্শন। আজও সাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে সালেহীনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে যেসমস্ত তালেবে ইলম, উলামায়ে কেরাম, মুহাদ্দিসীন ও দ্বীনের খাদেমগণ কামাই-রোজগারের রাস্তা ছেড়ে দ্বীন সংরক্ষণ ও প্রচারের কাজে জীবন বিলিয়ে যাচ্ছেন, তারা আযীমতের ওপরই আছেন।

এ আলোচনা তো প্রশ্নে বর্ণিত ২৯ এপ্রিল ২০২৩ ঈ.-এর বয়ান সম্পর্কিত, যা  বিষয়টির নাজুকতার কারণে দীর্ঘ হয়ে গেল। কিন্তু আলোচ্য ব্যক্তির সামগ্রিক চিন্তাধারা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার অনুসারীদের ছড়ানো ভুলভাল দলীল তলিয়ে দেখার জন্য এটা জরুরি ছিল। এরপর যদিও তার অন্য কোনো বয়ানের পর্যালোচনার জরুরত বাকি থাকেনি, তথাপি হুজ্জত পূর্ণ করার জন্য একটি ইজমালী পর্যালোচনা পেশ করা হচ্ছে।

ভুপালের উলামায়ে কেরাম এবং অন্যান্য ফতোয়াপ্রার্থী আরও যেসকল বয়ান পাঠিয়েছেন, সেগুলোর ওপর গভীর পর্যালোচনা শেষে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, আলোচ্য ব্যক্তি তার নিজস্ব মত ও বিকৃতি উম্মতের মাঝে চালু করার জন্য ‘সীরাতে সাহাবা’—এর মতো আকর্ষণীয় শিরোনাম বেছে নিয়েছেন। সালাফে সালেহীনের বক্তব্যসমূহ থেকে বিমুখ হয়ে সীরাত ও ইতিহাসের ঘটনাবলি থেকে কেবল নিজের বুঝের ওপর নির্ভর করে তিনি নানা বিষয় উদ্ভাবন করার পেছনে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছেন এবং সাধারণ উম্মতকেও সরাসরি সীরাতের ওপর গবেষণা চালানোর আহ্বান জানাচ্ছেন। তার (বয়ানে বার বার আসা) এ বাক্যগুলো প্রথমে লক্ষ করুন—

‘আপনারা সীরাত নিয়ে একটু ভাবুন’, ‘পাকা কথা, দেখে নিন সীরাতে’, ‘আমি বলছি, সীরাত সীরাত; এতেই কাজের উন্নতি এবং এতেই কাজের হেফাযত এবং কাজ করনেওয়ালাদের হেফাযত’, ‘মেহনত যেন হয় হুজুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের সীরাতের অনুগামী’, ‘সবচে বুনিয়াদি কথা হল, নিজের কাজকে সীরাতের অনুগামী বানাও’, ‘রাতে আমি আরজ করেছিলাম, অজ্ঞতা, সীরাত সামনে না থাকা এবং নিজের আদত-অভিজ্ঞতার আলোকে কাজ করা মানুষকে এমন জিনিসের বিরোধিতায় নামিয়ে দেয়, যা সরাসরি সুন্নত দ্বারা প্রমাণিত। এ বিষয়ে অনেক ভয়ে থাকা দরকার’, ‘নফর তথা খুরুজ ছাড়া দাওয়াতের কথা চিন্তাই করা যায় না। সাহাবীযুগে খুরুজ ছাড়া দাওয়াতের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। আপনারা নিজেরা সীরাত দেখে নিন’, ‘সাহাবায়ে কেরামের সীরাত নিয়ে আমি অনেক ভেবে ফেলেছি; তাঁদের দাওয়াতের ক্ষেত্রে সুন্নতের অনুসরণটাই বাতিল সন্ত্রস্ত হওয়ার মূল কারণ ছিল’, ‘দাওয়াতের কোনো কাজই এই ভেবে ছেড়ে দেওয়া যে, এর ওপর সব সাথী একমত নয়— এটা সরাসরি মুহাম্মাদ ও তাঁর সাহাবাগণের আমলের বিরুদ্ধাচরণ’, ‘আমি কালও বলেছি, যাই বলা হোক, তুমি নিজেই তা সাহাবায়ে কেরামের সীরাতে তালাশ করো। কারণ যত বেশি সীরাত দেখবে, কাজে তত বেশি প্রজ্ঞা বৃদ্ধি পাবে’, ‘কি আর বলব, আমাদের সবার সমস্যা হল, আমরা দাওয়াতের কাজকে নিজের আকল-বুদ্ধি দিয়ে চালাতে চাই, অথচ সবার দায়িত্ব হল, তোমরা দাওয়াতের কাজকে সাহাবীদের সীরাতে দেখো, সাহাবীদের সীরাতে দেখো’, ‘আমি আরজ করেছি, সাহাবায়ে কেরামের সীরাতে এত বেশি নারাজির উদাহরণ আর নেই, যতটা নারাজি আল্লাহর রাস্তায় বের হতে বিলম্ব করার কারণে হয়েছে’।

এখানেই তার সকল বিকৃতির শিকড় নিহিত। চিন্তা করলে বোঝা যায়, তার গলত চিন্তাধারার পেছনে সীরাত-তারীখের কোনো না কোনো ঘটনা থাকে, যা হয়তো তিনি ভুল বুঝেছেন, অথবা ঘটনার অন্যান্য বিবরণ সামনে রাখেননি, কিংবা উসূলে ফিকহ না জানার কারণে সঠিক নতিজা আহরণ করতে পারেননি, অথবা মুনকার ও মা‘লুল রেওয়ায়েতকে তিনি সহীহ ধরে নিয়েছেন! যেমন হযরত আবু বকর রা.-এর ঘটনা ভুল বোঝা, এ থেকে ভিত্তিহীন কথা বের করা এবং পুরো দ্বীনী শিক্ষাব্যবস্থাকে আক্রমণ করা— এগুলো এর তরতাজা উদাহরণ।

আলোচ্য ব্যক্তি দ্বীন এবং দ্বীনী দাওয়াতের একটা মনগড়া বানোয়াট নকশা তৈরি করে নিয়েছেন। ওটাকেই তিনি সুন্নত মনে করেন। ওটাকেই তিনি ‘সীরাত’ সাব্যস্ত করে দ্বীনী দাওয়াত ও শিক্ষা-দীক্ষার অন্যান্য শরীয়তসম্মত ও বৈধ পদ্ধতিকে প্রকাশ্যে রদ করেন এবং ভুল বলে ঘোষণা করে থাকেন।

তার দাবি হল, নবীযুগে তালীম-তরবিয়তের পুরো ব্যবস্থাপনা ছিল মসজিদ কেন্দ্রিক। যখন তা মসজিদ থেকে বাইরে বের হল, তখন জনমানুষের মাঝে জাহালত ছড়িয়ে পড়ল। তাই তিনি সর্বসমক্ষে বলে থাকেন, আজ বিশ্বব্যাপী দাওয়াত ও তালীম সুন্নত থেকে সরে গেছে! মসজিদের বাইরে দাওয়াত ও তালীম সুন্নত পরিপন্থী হওয়ার কারণে সুফলদায়ক হয় না, প্রভাব বিস্তার করতে পারে না।

তিনি এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য নবীযুগের ভুল চিত্র উম্মতের সামনে পেশ করা শুরু করেন। তার বয়ানের কয়েকটি অংশ লক্ষ করুন—

‘হুজুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তালীম-তরবিয়তের এক নেজাম বানিয়েছেন। সেই তালীম-তরবিয়তের নেজামকে হুজুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবাদতের মতো মসজিদের সাথে জুড়ে দিয়েছেন। নেজামে তালীমকে মসজিদ থেকে আলাদা করা তালীম ও তরবিয়তের মাঝে ফারাক সৃষ্টির নামান্তর। আমার বক্তব্য আপনাদের সবার কাছে অনেক মনোযোগের দাবি রাখে, এই দুটি বিষয় একটি অপরটির জন্য অপরিহার্য। হুজুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তালীম-তরবিয়তের যে নেজাম এনেছেন, সেটা পুরোই মসজিদে হত। পুরোই মসজিদের সাথে যুক্ত ছিল।’

‘যদি আমর বিল মারূফ আর নাহি আনিল মুনকার —আমি খোদার কসম করে বলছি— এই দুটি যদি সুন্নত মতো হয়; আমার অনেক দুঃখ-অনুযোগ— দাওয়াত ও তালীম হল নবীর মূল পদগত দায়িত্ব; আমি পুরো বিশে^র অবস্থা বলছি, এ দুই জরুরি কাজ সুন্নত থেকে বিচ্যুত হয়ে গিয়েছে। তালীম সুন্নত থেকে সরে যাবার ফলে তরবিয়ত হচ্ছে না। দাওয়াত সুন্নত থেকে সরার ফলে ঈমান আসছে না। ঈমানের পূর্ণতা এবং তালীমের পূর্ণতা— এই দুটি জিনিস জগদ্ব্যাপী সুন্নত থেকে সরে গেছে।’

‘আমার কথা মন দিয়ে শুনুন! নামায হল মসজিদের ‘যিমনী’ তথা পার্শ্বকাজ। নামায হল মসজিদের যিমনী কাজ। নামায হল মসজিদের যিমনী কাজ। মসজিদে ঈমান ও ইলমের মজলিস চলতে থাকত, এর ফাঁকে নামায দাঁড়িয়ে যেত। হযরত উমর বয়ান করছিলেন। বয়ানের মাঝে বললেন, এখন নামায পড়ে নাও। যেন নামায ইলমের হালকার মাঝে এসে যেত।’

‘আমার কথা আপনাদের অনেক খারাপ লাগছে। তিরমিযী শরীফের বর্ণনা, আল্লাহ ইয়াহইয়া আলাইহিস সালামকে হুকুম করলেন, বনি ইসরাইলকে বাইতুল মাকদিসে একত্রিত কর। সেখানে একত্রিত করে তাদের কাছে পাঁচটি কথা পৌঁছে দাও। আপনি হাদীসের ওপর চিন্তা করুন। প্রথম কথা— একত্রিত করুন। এটা নয় যে, জলসা অথবা একত্রিত হওয়ার তারিখ কোনো পত্রিকায় লিখে দাও বা ঘোষণা করে দাও যে, অমুক তারিখে ওখানে একত্রিত হবে! বরং আপনি একত্রিত করুন। দ্বিতীয় কথা— মসজিদে জমা করুন। কোনো ঘরে মাঠে হোটেলে নয়। বরং হুকুম হল একত্রিত করুন। কোথায়?’

‘নামাযে পূর্ণতা আসে দুই জিনিসের দ্বারা। এক হল ঈমান, দ্বিতীয় হল ইলম। প্রত্যেক ইবাদতে পূর্ণাঙ্গতা সৃষ্টির জন্য এবং প্রত্যেক আমলে কবুলিয়াত সৃষ্টির জন্য আসল জিনিস এ দুটি। আর এই দুটি জিনিস শেখার জায়গা মসজিদ। মসজিদ থেকে ইলম শেখা এতটা প্রভাবশালী যে, এক সাহাবী মসজিদে শুনলেন পর্দার বিধান এসে গেছে। তিনি গিয়ে মহল্লায় ঘোষণা দিলেন। মহিলারা তৎক্ষণাৎ পর্দায় চলে গেল। পুরো মহল্লায় এক মুহূর্তে পর্দা এসে গেল।’

‘আমি আপনাদেরকে আসল কথা বলে দিচ্ছি। যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে পলায়নপর কাফেরদেরকে সাহাবায়ে কেরাম ধরে বেঁধে নিজের সাথে মসজিদে নিয়ে আসতেন। গোলাম বানানোর জন্য নয়, কুরআনের মজলিসে বসানোর জন্য! মসজিদে আমলের পরিবেশে বসানোর জন্য, যাতে তাদের কানে কুরআনের আওয়াজ পড়ে এবং অন্তর থেকে কুফরের অন্ধকার দূর হয় আর ইসলাম কবুল করে নেয়। আমার কথা তোমাদেরকে মন দিয়ে শুনতে হবে।’

এ তো হল তার কথা। অথচ খাইরুল কুরুনে মসজিদের বাইরেও দাওয়াত ও তালীমের নেজাম প্রতিষ্ঠিত ছিল! মদীনা মুনাওয়ারায় তালীমের জন্য মসজিদের বাইরে ভিন্ন একটি ঘর নির্দিষ্ট করা ছিল। সেখানে এসে লোকজন কুরআনে কারীম শিখত। প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আব্দুল হাই কাত্তানী রাহ. তাঁর বিখ্যাত কিতাব—

نظام الحكومة النبوية /التراتيب الإدارية

-এ একটি শিরোনাম এনেছেন এমন—

اتخاذ الدار ينزلها القراء، ويستخرج منه اتخاذ المدارس

(অর্থাৎ কারীদের অবস্থানের জন্য ঘর নির্ধারণ আর এখান থেকে মাদরাসা বানানোর বিধান বের হয়)

এই শিরোনামের অধীনে হাফেজ ইবনু আব্দিল বার রাহ.-এর الاستيعاب في معرفة الأصحاب এবং তবাকাতে ইবনে সা‘দের বরাতে আল্লামা কাত্তানী রাহ. লিখেছেন, ‘বদর যুদ্ধের কিছু দিন পর মুসআব ইবনে উমায়ের রা.-এর সাথে আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রা. মদীনায় আসেন এবং ‘দারুল কুররা’-তে অবস্থান করতে থাকেন। এটি ছিল হযরত মাখরামা ইবনে নাওফাল রা.-এর ঘর। এখানে দ্বীনী তালীম দেওয়া হত। এ ঘটনা থেকে উলামায়ে কেরাম মাদরাসা নির্মাণের বিষয় প্রমাণ করে থাকেন।’

আল্লামা কাত্তানী রাহ. ইবনে কুদামা মাকদেসী রাহ.-এর কিতাব ‘আলইস্তেবসার’-এর সূত্রে আরো লিখেছেন, ‘হযরত মুসআব বিন উমায়ের রা. মদীনা মুনাওয়ারায় অবস্থান করতেন হযরত আসআদ ইবনে যুরারা রা.-এর ঘরে। তাঁরা দুজন আনসারদের বিভিন্ন ঘরে গিয়ে কুরআনে কারীম পড়াতেন, আল্লাহর পথে ডাকতেন।’

এখানে এ বিষয়টিও পরিষ্কার করে দেওয়া জরুরি যে, সাহাবায়ে কেরামের সীরাত ও আদর্শ নিঃসন্দেহে দ্বীন ও শরীয়তের অন্যতম দলীল ও মানদণ্ড। কিন্তু স্পষ্টতই— কুরআন-সুন্নাহ সঠিকভাবে বোঝার জন্য যেমন বিভিন্ন শর্ত ও মূলনীতি রয়েছে, তেমনি সাহাবায়ে কেরামের সীরাতের কোনো একটি ঘটনাকে উম্মতের সামনে আদর্শরূপে তুলে ধরা এবং বর্তমান হালতকে সীরাতে সাহাবার আলোকে যাচাই করে কর্মপন্থা ঠিক করারও কিছু মূলনীতি ও কায়দা-কানুন আছে।

ফুকাহায়ে কেরাম কুরআন-সুন্নাহ, সাহাবায়ে কেরামের কথা-কাজ ও সীরাতের আলোকে দ্বীনে ইসলামের সব শাখার ছোট-বড় মাসায়েল সুবিন্যস্তভাবে লিখে গিয়েছেন। (এর মধ্যে দাওয়াত ও তাবলীগের সকল উসূল ও আমলও শামিল আছে।) কিন্তু সাহাবায়ে কেরামের মতামত মুজতাহিদগণের তত্ত্বাবধানে (ইলমুল ফিকহ থেকে) আলাদা করে সংকলন করা হয়নি। এজন্য ফিকহ শাস্ত্র থেকে বিমুখ হয়ে শুধু বর্ণনা-ভাণ্ডার থেকে সাহাবায়ে কেরামের কিছু ঘটনা-বক্তব্য নিয়ে ইজতিহাদ করতে থাকলে, বিশেষ করে তা যদি ইলমী কমতি নিয়ে হয়, তাহলে তা ফেতনা-ফাসাদের বিরাট দরজা খোলার নামান্তর।

আল্লামা মুনাবী রাহ. ‘ফয়জুল কাদীর’ নামক গ্রন্থে ইমাম রাযী রাহ.-এর সূত্রে মুহাক্কিক উলামায়ে কেরামের ইজমা (ঐকমত্য) বর্ণনা করেন যে, ‘সাধারণ মানুষকে সরাসরি সাহাবায়ে কেরামের তাকলীদ করা থেকে বারণ করা হবে।’ (ফয়জুল কাদীর ১/২১০, মিশর; উসূলুল ইফতা ওয়া আদাবুহু, পৃ. ২৫৬)

তা এ কারণে নয় যে, তারা তাকলীদযোগ্য নন, নাউযু বিল্লাহ; বরং মূলত এজন্য যে, সাহাবীগণের বক্তব্য বা আমল এবং তাদের সীরাত সরাসরি বুঝতে গেলে ভুল হওয়ার সমূহ আশংকা আছে। এটা একদম সম্ভব যে, ইলমী কমতি ও অজ্ঞতার কারণে কোনো ব্যক্তি সাহাবায়ে কেরামের সীরাত সঠিকভাবে বুঝবে না, তাদের কথা-কাজের মানশা (মূল কার্যকারণ) ধরতে পারবে না। (ফলে সে সীরাতে সাহাবার নাম দিয়ে ভুল মাসআলা এবং ভুল উসূল আবিষ্কার করে বসবে।) কারণ আলাদাভাবে সাহাবায়ে কেরাম রা.-এর মাযহাব সুপরিচ্ছন্ন ও সুবিন্যস্ত আকারে নেই, বরং তা চার মাযহাবের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে আছে। (ইমাম নববীকৃত আলমাজমু শরহুল মুহাযযাব ১/৯১, আদাবুল মুসতাফতী অধ্যায়; আলবুরহান ফী উসূলিল ফিকহ, লিল জুওয়াইনী)

এর উদাহরণ হিসেবে আলোচ্য ব্যক্তি হযরত আবু বকর রা.-এর ঘটনা থেকে যা কিছু উদ্ভাবন করেছে এবং যেভাবে উদ্ভাবন করেছে তা লক্ষ করলেই ফুকাহায়ে কেরামের দূরদর্শিতা অনুধাবন করা সহজ হয়ে যায় যে, কেন তাঁরা সাহাবীর কোনো বক্তব্য বা আমলের সরাসরি তাকলীদ করতে বারণ করেছেন!

আলোচ্য ব্যক্তি হযরত আবু বকর রা.-এর ঘটনার ক্ষেত্রে কেবল ‘হায়াতুস সাহাবা’ নামক কিতাবের বর্ণনা দেখেছেন; এমনকি তিনি এই ঘটনার মূল উৎসগ্রন্থটাও খুলে দেখেননি। এ সম্পর্কিত সকল সূত্রের বর্ণনা একত্রিত করে দেখা তো বহুত দূরের কথা! তারপর আছে সহীহ-যয়ীফ এবং শুদ্ধ-অশুদ্ধ পার্থক্য করা এবং রেওয়ায়াত বিল মা‘না-এর প্রভাব বোঝার প্রসঙ্গ। সে তো অনেক অনেক ইলমী যোগ্যতা সাপেক্ষ বিষয়।

আরো মারাত্মক বিষয় হল, বর্ণনার মাঝে আলোচ্য ব্যক্তি নিজ থেকেও বাড়তি কথা জুড়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘হযরত আবু বকর রা.-এর আমল বলছে, উমর! খেলাফত আমাকে তেজারত থেকে বারণ করতে পারবে না।’ হযরত আবু বকর রা.-এর বাজারে রওয়ানা করা থেকেই তিনি একথা আবিষ্কার করে তাঁর দিকে সম্বন্ধ করে দিয়েছেন! কিন্তু হযরত উমর রা.-সহ অন্যান্য সাহাবায়ে কেরামের সাথে একমত হয়ে খেলাফতের পুরো সময় হযরত আবু বকর রা. তেজারত থেকে বিরত ছিলেন। এখান থেকে একথা তিনি বলতে পারলেন না যে, হযরত আবু বকর রা. খেলাফতের কাজে তেজারতকে প্রতিবন্ধক মনে করতেন! হযরত আবু বকর রা. তো পরিষ্কার বলেছেন—

لقد علم قومي أن حرفتي لم تكن تعجز عن مؤنة أهلي، وشغلت بأمر المسلمين.

(অর্থাৎ আমার কওম অবগত যে, আমার পেশা আমার পরিবারের খরচ যোগাতে সক্ষম। কিন্তু আমি মুসলমানদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি।)

আলোচিত ব্যক্তি এখানেই ক্ষান্ত হননি, হযরত আবু বকর রা.-এর দিকে স্পষ্টভাবে আরো সম্বন্ধ করে দিয়েছেন যে, ‘(হযরত আবু বকর রা.) বলেন, তেজারত কেন প্রতিবন্ধক হবে? এ কাজ (খেলাফত)-ও করব, তেজারতও করব!’ হযরত আবু বকর রা.-এর দিকে একথা সম্বন্ধ করা একদম গলত। আর এ কাজটিই করেছেন আলোচ্য ব্যক্তি।

তার এমন আচরণ নতুন কোনো ব্যাপার নয়। তিনি মনগড়া বিধান প্রমাণের জন্য হাদীস-আছার ও সীরাতের বিভিন্ন ঘটনায় এই ধরনের প্রক্ষেপণ করতে থাকেন। তার বয়ানে এর একাধিক নজির আছে।

মোটকথা

প্রথমত তিনি ঘটনা সংশ্লিষ্ট সকল বর্ণনা তাহকীক করার বিষয়ে অক্ষম।

দ্বিতীয়ত বর্ণনার মাঝে নিজ থেকে সংযোজন করেছেন।

তৃতীয়ত বুঝ-সমঝের কমির কারণে ভাসাভাসা ভুলভাল ইজতেহাদ করে আগের—পরের সমস্ত ফুকাহায়ে কেরামের রায়-বিরোধী নতিজায় উপনীত হয়েছেন।

হায়! হযরত উমর রা.-এর এ বাণীটি যদি তার জেহেনে থাকত—

لو كنت أطيق الأذان مع الخِلِّيفَى لأذنت.

(অর্থাৎ খেলাফতের কাজের সাথে সাথে আমার পক্ষে যদি সম্ভব হত, তবে আমি আযানও দিতাম। —মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস ২৩৪৮, ২৩৬০)

হযরত উমর রা. তো খেলাফতের ব্যস্ততার কারণে আযান দিতেও অক্ষমতা বোধ করছেন, কিন্তু ঐ ব্যক্তি হযরত আবু বকর রা.-এর ব্যাপারে বলছেন, সারা দুনিয়ার খেলাফতের কাজ আঞ্জাম দেওয়ার সাথে সাথে ব্যবসা করাও সম্ভব! কী আশ্চর্যকর কথা!

উপরোক্ত বিবরণ থেকে সুষ্পষ্ট যে, আলোচিত ব্যক্তি কুরআন-হাদীস ও সাহাবায়ে কেরামের ঘটনাবলি থেকে নিজস্ব এক বিশেষ মেযাজ ও চিন্তাধারা সামনে নিয়ে গলত নতীজা আহরণের চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ কারণে কখনো কখনো তার বয়ানভঙ্গির দ্বারা নবুওতের মহান মাকামেও আঁচ লেগে যায়। নবীগণের বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনার সময় নিজের বুঝ মোতাবেক ভিত্তিহীন কথা যোগ করতে থাকেন। এমন বিপজ্জনক ভঙ্গিতে তিনি কথা বলেন, যা আম্বিয়ায়ে কেরামের শান ও মানের উপযোগী নয়। ঘটনা এমনভাবে পেশ করেন, কেমন যেন তিনি নবীর ভুল ধরছেন এবং বার্তা দিতে চাচ্ছেন যে, এক্ষেত্রে নবীর ভুল হয়ে গেছে। এটা অনুসরণযোগ্য নয়; তোমরা এমন করো না! এ বিষয়ে তার একটা বয়ান লক্ষ করুন। তিনি বলছেন—

‘নবীদেরও আসবাব (উপায়-উপকরণ) এজন্যই লাভ হয়। খেয়াল করে শোনো আমি কী বলছি। নবীদেরও আসবাব লাভ হয় এজন্যই। আমাদের হাইছিয়তই বা কী; নবীদেরও আসবাব আল্লাহ এজন্যই দিয়ে থাকেন। মনোযোগ দিয়ে শোনো, আল্লাহ নবীদেরকেও আসবাব এজন্য দান করেন যে, আল্লাহ দেখতে চান, এখন এ আসবাবের কারণে সে আমাকে স্মরণ রাখে, নাকি আসবাবের কারণে আমার হুকুম নষ্ট হয়।

একটু তো ভেবে দেখো, সুলাইমান আ.-কে আল্লাহ এমন ঘোড়া দিলেন, এমন বিরল দুষ্প্রাপ্য ঘোড়া, এর আগেও এমন ঘোড়া মিলত না, পরেও আর মিলবে না। এমন সুন্দর ঘোড়া, আরোহীকে নিয়ে বাতাসে ওড়ে। এত শক্তিশালী যে, সমুদ্রে সাঁতার কাটে, জমিনে দাপিয়ে বেড়ায়। বড় সুদর্শন ঘোড়া। সুলাইমান আ. অশ্বদর্শনে বিভোর হয়ে গেলেন। এতটা বিভোর হলেন যে, আসরের নামায কাযা হয়ে গেল। ঘোড়া দেখতে দেখতে সূর্যাস্ত হল— আল্লাহ বানিয়েছেন! কীভাবে বানিয়েছেন! এমন বানিয়েছেন!

কথা হল, আল্লাহ যা কিছু সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টির প্রভাব তৈরির জন্য নয়; বরং স্রষ্টার প্রভাব তৈরির জন্য বানিয়েছেন। যেন সৃষ্টি থেকে স্রষ্টার প্রভাব পয়দা হয়। সুতরাং কাফের তারা, যারা সৃষ্টির প্রভাব গ্রহণ করে, আর মুসলমান তারা, যারা স্রষ্টার প্রভাব গ্রহণ করে। সৃষ্টি তো স্রষ্টার পরিচয়ের জন্য।

এসময় তো আল্লাহকে স্মরণ করার কথা, কিন্তু ঘোড়া দেখতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন এবং আসরের নামায কাযা হয়ে গেল! (সুলাইমান আ.) সময় দেখলেন, আরে! আসর তো পড়া হয়নি! এত সময়, এত সময় গেল, আসর কাযা হয়ে গেল! তিনি তলোয়ার আনিয়ে সব ঘোড়া খতম করে দিলেন। একটাও জীবিত রাখলেন না। ঐ ঘোড়ার প্রজন্মই শেষ করে দাও। এগুলো দেখতে দেখতে আসর কাযা হয়ে গেল!’

চিন্তা করো, আমল নষ্ট হওয়ার দুঃখ যাদের আছে, আল্লাহ তাদের আমল নষ্ট হতে দেন না। তিনি বললেন, তলোয়ার আনো! সব ঘোড়া কেটে ফেললেন। সবগুলো শেষ করে দিলেন। হে আল্লাহ! আমাকে আজকের আসর পড়তে হবে, আমি ঘোড়া চাই না, আমি আজকের আসর চাই!’

লক্ষ করুন, হযরত সুলাইমান আ.-এর ঘটনা আলোচ্য ব্যক্তি যে ভঙ্গিতে পেশ করেছেন এবং ঘটনার ভূমিকা বলে মাঝে আবার যে নতিজা বের করেছেন তা কতটা ভয়ংকর! তিনি নিজেই আসবাবের প্রভাব গ্রহণ করাকে কাফেরের কাজ আখ্যায়িত করছেন অন্যদিকে একজন মহান পয়গম্বরের ব্যাপারে বলছেন যে, তিনি আসবাব দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন! নাউযু বিল্লাহ! কোথায় গিয়ে ঠেকল কথা! অথচ আল্লাহ তাআলা হযরত সুলাইমান আ.-এর ঘটনা প্রশংসা করে বয়ান করেছেন। কুরআনে কারীমের আয়াত এমন—

وَ وَهَبْنَا لِدَاوٗدَ سُلَيْمٰنَ  نِعْمَ الْعَبْدُ اِنَّهٗۤ اَوَّابٌ،  اِذْ عُرِضَ عَلَيْهِ بِالْعَشِيِّ الصّٰفِنٰتُ الْجِيَادُ، فَقَالَ اِنِّيْۤ اَحْبَبْتُ حُبَّ الْخَيْرِ عَنْ ذِكْرِ رَبِّيْ  حَتّٰي تَوَارَتْ بِالْحِجَابِ، رُدُّوْهَا عَلَيَّ  فَطَفِقَ مَسْحًۢا بِالسُّوْقِ وَ الْاَعْنَاقِ.

এই বাক্যগুলো বয়ানদাতার আরেকবার ভেবে দেখা উচিত—

‘সুলাইমান আ. অশ্বদর্শনে বিভোর হয়ে গেলেন। এতটা বিভোর হলেন যে, আসরের নামায কাযা হয়ে গেল। ঘোড়া দেখতে দেখতে সূর্যাস্ত হল। আসর কাযা হয়ে গেল। আল্লাহ বানিয়েছেন! কীভাবে বানিয়েছেন! এমন বানিয়েছেন!

কথা হল, আল্লাহ যা কিছু সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টির প্রভাব তৈরির জন্য নয়; বরং স্রষ্টার প্রভাব তৈরির জন্য বানিয়েছেন। যেন সৃষ্টি থেকে স্রষ্টার প্রভাব পয়দা হয়। সুতরাং কাফের তারা, যারা সৃষ্টির প্রভাব গ্রহণ করে, আর মুসলমান তারা, যারা স্রষ্টার প্রভাব গ্রহণ করে। সৃষ্টি তো স্রষ্টার পরিচয়ের জন্য।

এসময় তো আল্লাহকে স্মরণ করার কথা, কিন্তু ঘোড়া দেখতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন এবং আসরের নামায কাযা হয়ে গেল!’

তার মানে, সুলাইমান আ. আসবাব দ্বারা প্রভাবিত হয়ে —নাউযুবিল্লাহ— পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছেন! ঘোড়া দেখে স্রষ্টার প্রভাব না নিয়ে সৃষ্ট ঘোড়ায় মশগুল হয়ে পড়েছেন! এ সময় আল্লাহকে স্মরণ না করে ঘোড়ায় মগ্ন হয়ে গেছেন!

আলোচ্য ব্যক্তির এজাতীয় বয়ান দ্বারা অনুমিত হয়, নবুওতের মাকাম এবং নবীগণের মাসুম হওয়ার বিষয়টি কত নাজুক— এ সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। একারণে তিনি নবীগণের ঘটনার ওপরও (লাগামহীন) ইজতিহাদসুলভ কথা বলতে থাকেন। ধৃষ্টতার সাথে এ ধরনের বাক্য বলতে বা এ ধারণা দিতে দ্বিধা করেন না যে, ‘নবীর এমন করা উচিত ছিল’।

আলোচ্য ব্যক্তির বয়ানে এমন বাক্য বেশ শোনা যায়— ‘একটি গলত চিন্তা এই’, ‘একালের লোকজন ভুল বুঝে আছে’, ‘এই ভুল বিশ্বব্যাপী’, ‘এটা সবার ইজতিমায়ী ভুল’, ‘এটা নিতান্তই বাতিল চিন্তা’ ইত্যাদি।

অর্থাৎ তিনি তার বয়ানে ঢালাওভাবে তানকিদ (সমালোচনা) করে থাকেন। এটা স্পষ্ট যে, যখন কোনো ব্যক্তি ইলমী কমতি সত্ত্বেও অন্যায় সমালোচনা করে, সে মূলত নিজের ইলম ও সমঝকে সর্বোচ্চ বলে মনে করে। ফলে আলোচ্য ব্যক্তি যখন বলেন, বিশ্বব্যাপী দাওয়াত ও তালীম সুন্নতের রাস্তা থেকে সরে গেছে, তখন এ কথার আড়ালে তার প্রচ্ছন্ন দাবি হল, দাওয়াত ও তালিমের নববী তরীকা যুগের আহলে হক উলামায়ে কেরাম থেকেও আমি বেশি বুঝি।

ইসলামের ইতিহাসে বক্রতা ও ভ্রষ্টতার শিকার ব্যক্তিদের বিষয়ে চিন্তা করলে দেখা যায়, এটাই ছিল তাদের বিপথগামিতার অন্যতম কারণ যে, ইজতিহাদী যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও তারা মুজতাহিদ ইমাম, সালাফে সালেহীন এবং সমকালের আহলে হক উলামায়ে কেরামের ওপর আস্থা রাখার পরিবর্তে খোদরায়ী ও খোদরবী তথা নিজস্ব মত ও পথকে চূড়ান্ত ও একমাত্র মত ও পথ মনে করে নিজেদের জন্য আলাদা রাস্তা বানিয়ে নিয়েছে।

সুতরাং ৩১ জানুয়ারি ২০১৮ সনে জারিকৃত পরিপত্রে দারুল উলূম দেওবন্দ যে বিষয়ে সতর্ক করেছে, তা ছিল বিলকুল বাস্তবসম্মত। আলোচ্য ব্যক্তি ইলমী কমতি ও বেপরোয়া মনোভাবের কারণে কুরআন-হাদীস ও সীরাতে সাহাবার মাঝে মুজতাহিদসুলভ ভঙ্গিতে স্বাধীনভাবে নিজের বুঝ-বুদ্ধি খাটিয়ে বেকার ইজতিহাদ করার পেছনে পড়ে আছেন। ফলে শায-মুনকার কথাবার্তা এবং ভ্রষ্টতা ও বিভ্রান্তিপূর্ণ চিন্তাধারা ক্রমাগতভাবে প্রকাশ পেয়েই চলেছে।

যে ব্যক্তি দ্বীনী বিষয়ে বিপথগামিতার শিকার— হিকমত ও প্রজ্ঞা এবং সঠিক কর্মপদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে তার গলত চিন্তাধারা থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করা উলামায়ে কেরামের বড় যিম্মাদরি।

যে সমস্ত ওয়ায়েয জনমানুষকে আকর্ষণ করার জন্য শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে আপত্তিকর কথাবার্তা ও বিরল-বিস্ময়কর কিচ্ছা-কাহিনী বলে বেড়ায়, মানুষের জেহেনে ইসলামের ভুল চিত্র বসানোর চেষ্টা করে, তাদের ওপর হাফেজ সুয়ূতী রাহ. ও হাফেজ ইবনুল জাওযী রাহ. কঠিন আপত্তি করেছেন। (দেখুন তাহযীরুল খাওয়াস মিন আকাযীবিল কুসসাস, কিতাবুল কুসসাসি ওয়াল মুযাক্কিরীন)

ইবনে কুতাইবা রাহ. লিখেছেন, ‘অজ্ঞতার কারণে সাধারণ মানুষ এমন বয়ানিকে বেশি পছন্দ করে, যার বয়ানে সাধারণ নিয়ম বিবর্জিত আজব আজব নতুন কথা আসে।’

অথচ এমন বক্তাদের বিষয়ে সাহাবা ও তাবেয়ীন শক্ত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।

এখন আপনাদের প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর পেশ করা হচ্ছে—

১. আলোচ্য ব্যক্তির যেসব বয়ান পাঠানো হয়েছে, সেগুলো শরীয়তের দৃষ্টিতে ঠিক নয়। এসমস্ত বয়ানের অধিকাংশ কথা শরয়ী নসের মনগড়া ব্যাখ্যা এবং কুরআন-হাদীস ও সীরাতে সাহাবার ভুল বা মারজুহ ব্যাখ্যা। এ ধরনের বয়ান সামনে চালানো এবং যে কোনো মাধ্যমে এগুলোর প্রসার ঘটানো জায়েয নয়। বয়ানদাতার ওপর এজাতীয় বক্তব্য সম্পূর্ণরূপে পরিহার করা জরুরি। বয়ান-বক্তৃতায় সালাফে সালেহীন এবং আমাদের আকাবিরের ব্যাখ্যা অনুসরণ করা তার একান্ত কর্তব্য। এ থেকে সামান্যতম বিচ্যুত হয়ে বিবাদ-বিশৃঙ্খলার কারণ হওয়া থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। এটাই নিরাপদ রাস্তা, এতেই সবার মঙ্গল।

২. যারা জেনেবুঝে এই ধরনের বয়ানের কোনো ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে চাচ্ছেন, বয়ানদাতার মতকে সুরক্ষা দিয়ে সরলমনা মানুষকে ভুল পথে নামিয়ে দিচ্ছেন, তাদের আচরণ দুঃখজনক। তারা আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য হবেন।

৩. দারুল উলূম দেওবন্দ কখনই একটি জামাত হিসেবে তাবলীগ জামাতের বিরোধী ছিল না। এটা তো আমাদেরই আকাবিরের বানানো একটি গুরুত্বপূর্ণ জামাত এবং তা দ্বীনের প্রচার-প্রসারের একটি উপকারী মাধ্যম।

ইতিপূর্বেও দারুল উলূম দেওবন্দ (আলোচ্য ব্যক্তির ব্যাপারে) বিস্তারিতভাবে নিজের অবস্থান আহলে ইলমের খেদমতে প্রচার করে দ্বীনী দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েছে এবং এখনো আপন মতে কায়েম আছে। আর এখন একই বিষয়ে আরো বিস্তারিত ও দলীলযুক্তভাবে নিজেদের রায় ও অবস্থান আহলে ইলমের খেদমতে পেশ করছে। সাধারণ মানুষের উচিত, আলোচ্য বিষয়ে ঐসকল নির্ভরযোগ্য স্থানীয় উলামায়ে কেরামের কাছে রুজু করা, যাদের কাছ থেকে শরীয়তের অন্যান্য বিষয়ে তারা নির্দেশনা গ্রহণ করে থাকে।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সিরাতে মুস্তাকীমের ওপর অবিচল রাখুন এবং উম্মতে মুসলিমাকে সব ধরনের ফেতনা-ফাসাদ থেকে হেফাজত করুন— আমীন।

বঙ্গানুবাদ

ইফতা, মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা

আরবী উদ্ধৃতিসমূহ :

حضرت ابو بكر صديق رضى اللہ عنہ كے واقعہ سے متعلق تخريجات اور محدثين وفقہاء كى تصريحات

في حياة الصحابة: ২/৫১৬) ، ت بشار (

قصةردأبيبكرالصديقرضياللهعنهالمال

قصةردِّهرضياللهعنهوظيفتهمنبيتالمال

أخرج البيهقي عن الحسن أن أبا بكر الصديق رضي الله عنه خطب الناس فحمد الله وأثنى عليه، ثم قال: >إنَّ أكيسَ الكَيْس التقوى<— فذكر الحديث، وفيه: فلما أصبح غدَا إلى السوق، فقال له عمر رضي الله عنه: >أين تريد؟< قال: >السوق<، قال: >قد جاءك ما يشغلك عن السوق<، قال: >سبحان الله، يشغلني عن عيالي؟<، قال: >نَفْرض بالمعروف<، قال: >ويحَ عمر! إِني أخاف أن لا يسَعَني أن آكل من هذا المال شيئا<. قال: فأنفق في سنتين وبعض أخرى ثمانية آلاف درهم، فلما حضره الموت، قال: >قد كنت قلت لعمر: إني أخاف أن لا يسَعَني أن آكل من هذا المال شيئا، فغلبني، فإذا أنا متُّ فخذوا من مالي ثمانية آلاف درهم ورُدُّوها في بيت المال< قال: فلما أُتي بها عمر قال: >رحم الله أبا بكر، لقد أتعب مَن بعده تعبا شديدا<.

تخريجالرواياتالمتعلقةبهذهالقصة:

أخرج البخاري في >صحيحه< (২০৭০) قال: حدثنا إسماعيل بن عبد الله قال: حدثني ابن وهب، عن يونس، عن ابن شهاب قال: حدثني عروة بن الزبير أن عائشة رضي الله عنها قالت: لما استخلف أبو بكر الصديق قال: >لقد علم قومي أن حرفتي لم تكن تعجز عن مؤنة أهلي، وشُغلْتُ بأمر المسلمين، فسيأكل آل أبي بكر من هذا المال، ويحترف للمسلمين فيه<.

وأخرج ابن سعد في >الطبقات الكبرى< (৩/১৯২، دار صادر) وابن أبي شيبة في >مصنفه< (২২৬১৯) عن وكيع، وأبو عوانة في >مستخرجه< (১০৪৯৭)، والبيهقي في >السنن الكبرى< (৬/৩৫৩) من طريق ابن نمير، به، وأخرج ابن سعد (৩/১৯২—১৯৩) من طرق مختلفة. قال ابن حجر في >فتح الباري< (৪/৩০৪): >روى ابن سعد وابن المنذر بإسناد صحيح عن مسروق عن عائشة<. اﻫ.

وأخرجه أبو عبيد في >الأموال< (৬৬০)، وابن زنجويه في >الأموال< (৯৮৪) من طريق أبي النضر (وهو هاشم بن القاسم)، عن سلميان بن المغيرة، به. رجاله ثقات.

وأخرجه الإمام أحمد في >الزهد< (ص ৯১) من طريق عبد الله بن عمر، عن عبد الرحمن بن القاسم، به.

قال البوصيري في >إتحاف الخيرة< (৭/১৪৮): >رواه مسدد بسند فيه سمية، ولم أر من ذكرها بعدالة ولا جرح، وباقي رواة الإسناد ثقات<. اﻫ. سمية البصرية تروي عن عائشة، روى عنها ثابت البناني فقط، من الطبقة الوسطى من التابعين، قال ابن حجر في >التقريب<: >مقبولة<.

وأخرج الطبراني في >المعجم الكبير< (১/৬০). رجاله ثقات، وفيه انقطاع؛ فإن عبد الله بن الحسن لم يسمع من جده الحسن بن علي رضي الله عنه، لأن عبد الله بن الحسن ولد سنة ৭০ﻫ، وجده الحسن بن علي رضي الله عنه توفي سنة ৪৯ ﻫ وقيل: سنة ৫০ﻫ.

وأخرجه ابن عساكر في >تاريخه< (৬১/২৭৫—২৭৭).

تخريجالروايةالمذكورةفي >حياةالصحابة

أخرج البيهقي في >السنن الكبرى< (৬/৩৫৩)، قال: أخبرنا أبو عبد الله الحافظ (وهو الحاكم)، أخبرنا محمد بن طاهر بن يحيى، حدثني أبي، أخبرنا محمد بن أبي خالد الفراء، حدثنا أبي، حدثنا المبارك بن فضالة، عن الحسن أن أبا بكر رضي الله عنه خطب الناس فحمد الله وأثنى عليه، ثم قال: >إن أكيس الكيس التقوى، وأحمق الحمق الفجور، ألا وإن الصدق عندي الأمانة، والكذب الخيانة، ألا وإن القوي عندي ضعيف حتى آخذ منه الحق، والضعيف عندي قوي حتى آخذ له الحق، ألا وإني قد وُلِّيت عليكم ولست بأخيركم< —قال الحسن: >هو والله خيرهم غير مدافع، ولكن المؤمن يهضم نفسه<—، ثم قال: >ولوددت أنه كفاني هذا الأمر أحدكم —قال الحسن: >صدق والله<—، وإن أنتم أردتموني على ما كان الله يقيم نبيه من الوحي ما ذلك عندي، إنما أنا بشر، فراعوني. فلما أصبح غدَا إلى السوق، فقال له عمر رضي الله عنه: >أين تريد؟< قال: >السوق<. قال: >قد جاءك ما يشغلك عن السوق<، قال: >سبحان الله! يشغلني عن عيالي؟<. قال: >نفرض بالمعروف<، قال: >ويح عمر، إني أخاف أن لا يسعني أن آكل من هذا المال شيئا<، قال: فأنفق في سنتين وبعض أخرى ثمانية آلاف درهم. فلما حضره الموت قال: >قد كنت قلت لعمر: إني أخاف أن لا يسعني أن آكل من هذا المال شيئا، فغلبني، فإذا أنا مت فخذوا من مالي ثمانية آلاف درهم وردوها في بيت المال<. قال: فلما أتي بها عمر رضي الله عنه قال: >رحم الله أبا بكر، لقد أتعب مَن بعده تعبا شديدا<.

محمد بن طاهر بن يحيى: روى عنه الحاكم في >مستدركه< وصحح حديثه وترجم له في >تاريخه<، ولم يذكر فيه جرحا ولا تعديلا.

وأبوه طاهر بن يحيى بن قبيصة، قال السمعاني في >الأنساب< (১০/২৪০—২৪১): >كان من كبار المحدثين لأصحاب الرأي<.

محمد بن أبي خالد الفراء، لم نجد فيه مزيدا على ما قال السمعاني في >الأنساب< (১০/১৫৩): >أبو أحمد محمد بن أبي خالد يزيد بن صالح الفراء، هو ابن أبي صالح، نيسابوري، سمع أباه ويحيى بن يحيى، روى عنه طاهر بن يحيى ومكي بن عبدان وغيرهما، مات في شعبان سنة ست<.

أبو خالد الفراء هو يزيد بن صالح اليشكري، صدوق، قاله الذهبي في >سير أعلام النبلاء< (৪/৪৭৯).

هذا من مراسيل الحسن، مع ما في الإسناد إليه غير واحد لم يوقف على حاله.

خلاصة ما في الروايات المتعلقة بقصة رد أبي بكر الصديق رضي الله عنه وظيفته من بيت المال مقارَنا برواية البيهقي

ذُكرتْ في رواية البيهقي أمور:

منها: ذهابه إلى السوق بعد تولي الخلافة، ومنع عمر له، ثم فرض الراتب له من بيت المال. وهذه القصة جاءت في رواية الواقدي ومرسل عطاء بن السائب وحميد بن هلال، وهُما من طبقة التابعين، واستدل ابن حجر بمرسل عطاء بن السائب في >فتح الباري<، على أن المفروض لأبي بكر من بيت المال كان باتفاقٍ من الصحابة.

ومنها: وصية أبي بكر الصديق رضي الله عنه في مرضه الذي مات فيه برد ما أنفق من بيت المال في عهد خلافته، ومقداره في رواية البيهقي (فيه غير واحد ممن لا يعرف مع إرسال الحسن): ثمانية آلاف درهم، وفي مرسل ابن سيرين (رجاله ثقات): ستة آلاف درهم.

وقد جاء في روايات أخرى أنه أوصى برد ما بقي عنده من بيت المال، وهو في رواية مسروق عن عائشة (رجاله ثقات): عبد وبعير ناضح، وفي رواية القاسم عن عائشة (رجاله ثقات): اللقحة والغلام، وفي رواية سمية عن عائشة (إسناده لا بأس به): اللِّقْحة والقَدَح، وفي رواية البَكَّائي عن عائشة (فيه ضعف وانقطاع): خادم وبعير ناضح، وفي رواية أنس (رجاله ثقات): خادم ولقحة ومِحْلب، وفي رواية الحسن بن علي (فيه انقطاع): لقحة وجفنة وقطيفة، وفي رواية أبي بكر بن حفص بن عمر (مرسل رجاله ثقات): عبد وبعير ناضح وجَرْدُ قطيفةٍ، وفي رواية محمد بن الأشعث (فيه من لا يعرف): جارية ولقحتان وحالبهما، وفي رواية الواقدي: لقحة وعبد وقطيفة.

وأما رواية عروة عن عائشة التي في >صحيح البخاري< فهي مختصرة، وليس فيها تعرُّضٌ للوصية برد المال.

السنن الكبرى للبيهقي: (২০২৮৮)

باب ما يكره للقاضي من الشراء والبيع، والنظر في النفقة على أهله وفي ضيعته، لئلا يشغل فهمه.

أسند فيه عن الزهري قال: حدثني عروة بن الزبير أن عائشة زوج النبي قالت: لما استخلف أبو بكر، قال: >قد علم قومي أن حرفتي لم تكن لتعجز عن مؤنة أهلي، وقد شغلت بأمر المسلمين، فسيأكل آل أبي بكر من هذا المال، وأحترف للمسلمين فيه<.

وأسند عن عائشة رضي الله عنها زوج النبي قالت: >لما استخلف عمر بن الخطاب أكل هو وأهله من المال، واحترف في مال نفسه<.

قال البيهقي رحمه الله: أخرجه البخاري في >الصحيح< من حديث يونس عن الزهري، كما مضى في كتاب القسم. قال: ورُوِّينا عن الحسن أن أبا بكر رضي الله عنه خطب الناس حين استخلف، فذكر الحديث. قال: فلما أصبح غدا إلى السوق، فقال له عمر رضي الله عنه: >أين تريد؟< قال: >السوق<. قال: >وقد جاءك ما يشغلك عن السوق<؟ قال: >سبحان الله! يشغلني عن عيالي؟< قال: >نفرض بالمعروف<— ثم ذكر الحديث، وذكر فيه وصيته برد ما أخذ منه في بيت المال.

صحيح البخاري: (২৭৭৬)

روى عن أبي هريرة رضي الله عنه: أن رسول الله ‘ قال: >لا يقتسم ورثتي دينارا، ما تركتُ بعد نفقة نسائي ومَؤُونة عاملي فهو صدقة<.

شرح صحيح البخاري لابن بطال: (৫/২৫৯، مكتبة الرشد، بالرياض)

قال ابن بطال:قال الطبرى أنه قال: >وفيه من الفقه: أن من كان مشتغلا من الأعمال بما فيه لله بر وللعبد عليه من الله أجر، أنه يجوز أخذ الرزق على اشتغاله به، إذا كان في قيامه سقوط مَؤُونة عن جماعة من المسلمين أو عن كافتهم، …، والمؤذنين أخذ الأرزاق على تأذينهم، والمعلمين على تعليمهم. وذلك أن النبى جعل لولي الأمر بعده فيما كان أفاء الله عليه مؤنتَه، وإنما جعل ذلك لاشتغاله، فبان أن كل قيِّم بأمر من أمور المسلمين، مما يعمهم نفعه: سبيله سبيل عامل النبي صلى الله عليه وسلم<.

مرقاة المفاتيح: (৫৯৭৫، ৫৯৭৪)

قال الملا علي القاري: >وقوله ومُؤْنة عاملي: أراد بالعامل الخليفة بعده، وكان النبي يأخذ نفقة أهله من الصفايا، التي كانت له من أموال بني النضير وفَدَك، ويصرف الباقي في مصالح المسلمين، ثم ولِيها أبو بكر ثم عمر كذلك. …وقال بعض المحققين: اختلف في المراد بقوله: (مُؤْنة عاملي) فقيل: الخليفة بعده، وهذا هو المعتمد<.

وقال نقلا عن العلامة الكرماني في >شرح البخاري<: >هي نصف أرض فدك، وثلث أرض وادي القرى، وسهمه من خُمُس خيبر، وحصة من أرض بني النضير<.

وانظر أيضا: >لامع الدراري< (৭/১৯৯، المكتبة الإمدادية، بمكة المكرمة)

شرح الطريقة المحمدية للنابلسي: (২/৪৯০)

>وأما مصارف بيت المال، فهم المقاتلةُ من العساكر والأمراءُ، والولاة والقضاة، والمحتسبون والمفتون، والمعلمون والمتعلمون، وقراء القرآن والمؤذنون، وكل من قلد شيئا من مصالح أمور المسلمين. وقال شيخ الإسلام خواهرزاده في شرح القدوري: وأهل العطاء في زماننا القاضي والمدرس والمفتي<.

قال النابلسي: ذكر قاضي خان في >فتاواه< من باب الحظر والإباحة أنه سئل علي الرازي عن بيت المال: هل للأغنياء فيه نصيب، قال: لا، إلا أن يكون عاملا أو قاضيا أو فقيها فرغ نفسه لتعليم النساء الفقه أو القرآن<، وقال العلامة زين الدين ابن نجيم: >وليس مراد الرازي الاقتصار على العامل والقاضي؛ بل أشار بهما إلى كل من فرغ نفسه للمسملين، فيدخل الجندي والمفتي<.

بريقة محمودية في شرح طريقة محمدية: (৪/২৪০، ২৫০، مطبعة الحلبي عام ১৩৪৮ﻫ)

(الفصل الثاني في التورع) التكلف في تحصيل الورع (والتوقي) التحفظ (من طعام أهل الوظائف من الأوقاف أو) من (بيت المال مع اختلاط) هذا المتورع مع (الجهلة والعوام وأكل طعامهم)، مع أن الأولى له أن يجتنب عن هؤلاء، (وهذا) التورع (ناشئٌ من الجهل) بحقيقة الحال (أو) من (الرياء)، فيتجنب ليرى الناس أنه ورع، (فكما أن الكسب بالبيع والشراء والإجارة ونحوها) كالزرع وأنواع الحِرَف (إذا روعي فيها شرائط الشرع حلال)، بل (طيِّبٌ كذلك الوقف إذا صح وروعي) فيه (شرائط الوقف)، وللمانع أن يقول: يجوز أن يكون تورع المتورع للاشتباه في صحة أصل الوقف وفي تحقق شرائطه ووقوعه في مصرِفه وقدره سيما في زماننا (فلا شبهة فيه) أي في حاله (أصلا)، وللمانع أيضا أن يقول: إن شرط الواقف لو كان لنفس ذلك الموقوف عليه، فكيف يسوغ أن يبيح أو يهَب إلى غيره، بل أوقاف بيت المال مختصة بقدر الكفاية؛ ولذا كانت الزيادة على الكفاية في شبهة (إذ الصحابة رضوان الله عليهم أجمعين وقفوا)، قيل عن البخاري: أول من وقف عمر رضي الله تعالى عنه —وكان في عهده— لسهمه من خيبر، (وأكلوا منه)، ولم ينقل الإنكار منهم، فيحل محل الإجماع، (وكذا بيت المال يحل لمن كان مصرِفا له إذا أخذ منه بقدر الكفاية) لنفسه وخادمه وأهله وأولاده، والكتب اللازمة له إن كان عالما، وفي >المنح<: لكل قارئ في كل سنة مائتا دينار أو ألفا درهم إن أخذها في الدنيا، وإلا أخذها في الآخرة، كذا قيل في >مآل الفتاوى< أيضا، (وقد أخذ الخلفاء الأربعة رضي الله تعالى عنهم سوى عثمان رضي الله تعالى عنه منه)، أي من بيت المال، وعدم أخذ عثمان لغناه وعدم احتياجه؛ إذ روي أنه كان لعثمان رضي الله تعالى عنه عند خادمه يوم قتْله مائة ألف ألف وخمسون ألف ألف دينار وألف ألف درهم، وخلَّف أَجْباء، قيمتُها مائتا ألف دينار، وبلَغ ثمنُ مال الزبير خمسين ألف دينار، وترك ألف فرس وألف مملوك، وخلَّف عمرو بن العاص ثلاثمائة ألف دينار، وغنى عبد الرحمن بن عوف أشهر من أن يذكر، فكانت الدنيا في أكُفِّهم لا في قلوبهم كما نقل عن >التنوير<، لكنهم مع مثل هذه الأموال العظام ليسوا من أهل الدنيا، لعدم حبهم إياها وعدم شغل قلوبهم في وجوهها، بل معظم قصدهم بذل تلك الأموال إلى المحاويج ووجوه البر وطرق الحسنات، كما روي أنه لم يبق في غُزاة تبوك أحد لم يصِل إليه مال عثمان رضي الله تعالى عنهم، وقد روي من ثلاثين ألفا إلى ثمانين ألفا، (فلا فرق بين الوقف وبيت المال وبين غيرهما من المكاسب في) أصل (الحل والطيب، إذا روعي شرائط الشرع، ولا في الحرمة والخبث، إذا لم تراع) شرائطه، (بل الأولان) الوقف، وبيت المال (أشبه وأمثل في زماننا).

عمدة القاري للعيني: (১১/১৮৬، دار إحياء التراث العربي، بيروت)

>وكل من يتولى عملا من أعمال المسلمين، يعطى له شيء من بيت المال؛ لأنه يحتاج إلى كفايته وكفاية عياله، لأنه إن لم يعط له شيء، لا يرضى أن يعمل شيئا، فتضِيع أحوال المسلمين، وعن ذلك قال أصحابنا: ولا بأس برزق القاضي. وكان شريح رضي الله تعالى عنه يأخذ على القضاء، ذكره البخاري في باب رزق الحكام والعاملين عليها<.

كتاب الخراج لأبي يوسف: (ص২০৫، المكتبة الأزهرية للتراث)

>فصل في أرزاق القضاة والعمال

وسألتَ: من أي وجه تُجْري على القضاة والعمال الأرزاق؟ فاجعل —أعز الله أمير المؤمنين بطاعته— ما يجري على القضاة والولاة من بيت مال المسلمين: من جباية الأرض أو من خراج الأرض والجزية؛ لأنهم في عمل المسلمين، فيجري عليهم من بيت مالهم، ويجري على كل والي مدينة وقاضيها بقدر ما يحتمل. …وكل رجل تُصيِّره في عمل المسلمين فأَجْرِ عليه من بيت مالهم، ولا تُجْر على الولاة والقضاة من مال الصدقة شيئا، إلا والي الصدقة؛ فإنه يجري عليها منها، كما قال الله تبارك وتعالى {وَالْعَامِلِيْنَ عَلَيْهَا}. …ولم تزل الخلفاء تُجْري للقضاة الأرزاق من بيت مال المسلمين<.

نصب الراية: (৪/১৩৭، مؤسسة الريان للطباعة والنشر، بيروت)

وقد روي عن عمر بن الخطاب أنه كان يرزق المعلمين.

ثم أسند عن إبراهيم بن سعد عن أبيه أن عمر بن الخطاب كتب إلى بعض عماله أن أعط الناس على تعليم القرآن.

تبيين الحقائق: (৬/৩৩، المطبعة الكبرى الأميرية، بولاق، القاهرة)

(ورزق القاضي) أي حل رزق القاضي من بيت المال؛ لأن بيت المال أُعدَّ لمصالح المسلمين، والقاضي محبوس لمصالحهم، والحبس من أسباب النفقة، فكان رزقه فيه، كرزق المقاتلة والزوجة يعطى منه ما يكفيه وأهلَه، على هذا كانت الصحابة والتابعون. وبعث رسول الله عَتَّاب بن أَسِيد إلى مكة وفرض له، وبعث عليا ومعاذا إلى اليمن وفرض لهما، وكان أبو بكر والخلفاء من بعده يأخذون كفايتهم، فكان إجماعا.

البناية للعيني: (১২/২৭৩، دار الكتب العلمية، بيروت، لبنان)

وفي >مصنف عبد الرزاق<: أخبرنا الحسن بن عمارة، عن الحكم: أن عمر بن الخطاب رضي الله تعالى عنه رزق شريحا وسلمان بن ربيعة الباهلي على القضاء.

وروى ابن سعد في >الطبقات< في ترجمة شريح: أخبرنا الفضل بن دكين، حدثنا الحسن بن صالح، عن ابن أبي ليلى قال: بلغني أن عليا رضي الله تعالى عنه رزق شريحا خمسمائة. وروى في ترجمة زيد بن ثابت رضي الله تعالى عنه: أخبرنا عفان بن مسلم، حدثنا عبد الواحد بن زياد، عن الحجاج بن أرطاة، عن نافع قال: استعمل عمر بن الخطاب رضي الله تعالى عنه زيد بن ثابت على القضاء وفرض له رزقا.

وقال أيضا: أخبرنا محمد بن عمر الواقدي، أخبرنا عبد الله بن عمر، عن نافع، عن عبد الله بن عمر رضي الله تعالى عنهما قال: بويع أبو بكر الصديق رضي الله تعالى عنه يوم قبض رسول الله، يوم الإثنين لإثنتي عشرة ليلة خلت من ربيع الأول، سنة إحدى عشرة من الهجرة، وكان رجلا تاجرا يغدو كل يوم إلى السوق فيبيع ويبتاع، فلما بويع للخلافة قال: والله ما يصلح للناس إلا التفرغ لهم والنظر في شأنهم، ولا بد لعيالي ما يصلحهم، فترك التجارة، وفرض من مال المسلمين ما يصلحه ويصلح عياله يوما بيوم، وكان الذي فرضه له، في كل سنة ستة آلاف درهم، فلما حضرته الوفاة قال لهم: >ردوا ما عندنا إلى مال المسلمين، وإن أرْضِي التي هي بمكان كذا وكذا للمسلمين، بما أصبتُ من أموالهم<، فدفع ذلك إلى عمر رضي الله تعالى عنه، فقال: >لقد والله أتعبْتَ مَن بعدك<.

الخانية على هامش الهندية: (২/৩২৫، كتاب الإجارة)

قال الشيخ الإمام أبو بكر محمد بن فضل رحمه الله: >إنما كره المتقدمون الاستئجار لتعليم القرآن، وكرهوا أخذ الأجر على ذلك؛ لأنه كان للمعلمين عطيَّاتٌ في بيت المال في ذلك الزمان، وكان لهم زيادة رغبة في أمر الدين وإقامة الحِسْبة، وفي زماننا انقطعت عطياتهم وانقضت رغائب الناس في أمر الآخرة، فلو اشتغلوا بالتعليم مع الحاجة إلى مصالح المعاش لاختلَّ معاشهم، فقلنا بصحة الإجارة ووجوب الأجرة للمعلم، بحيث لو امتنع الوالد عن إعطاء الأجر حُبِس فيه<.

أحكام القرآن للجصاص: (২/৩৬৩، دار إحياء التراث العربي، بيروت)

إن الرزق ليس بأجرة لشيء، وإنما هو شيء جعله الله له ولكل من قام بشيء من أمور المسلمين، ألا ترى أن الفقهاء لهم أخذ الأرزاق.

صحيح البخاري: (৭১৬৩، باب رزق الحكام والعاملين عليها)

حدثنا أبو اليمان، أخبرنا شعيب، عن الزهري، أخبرني السائب بن يزيد ابن أخت نمِر: أن حويطب بن عبد العزى أخبره: أن عبد الله بن السعدي أخبره: أنه قدم على عمر في خلافته، فقال له عمر: >ألم أُحدَّث أنك تلي من أعمال الناس أعمالا، فإذا أُعطيتَ العُمالة كرهتَها؟< فقلت: بلى، فقال عمر: >فما تريد إلى ذلك؟< قلت: إن لي أفراسا وأعبُدا، وأنا بخير، وأريد أن تكون عمالتي صدقة على المسلمين. قال عمر: >لا تفعل، فإني كنت أردتُ الذي أردتَ، فكان رسول الله يعطيني العطاء، فأقول: أعطه أفقر إليه مني، حتى أعطاني مرة مالا، فقلت: أعطه أفقر إليه مني<، فقال النبي ‘: >خذه، فتموَّلْه، وتصدق به، فما جاءك من هذا المال وأنت غير مُشْرف ولا سائل فخذه، وإلا فلا تتبعه نفسك<.

فتح الباري: (১৩/১৫৪، دار المعرفة، بيروت)

قال الطبري: >في حديث عمر الدليل الواضح على أن لمن شغل بشيء من أعمال المسلمين: أخذ الرزق على عمله ذلك، كالولاة والقضاة وجُباة الفيء، وعمال الصدقة وشبههم، لإعطاء رسول الله عمر العمالة على عمله<.

تاريخ دمشق: (২৪/৩৫، دار الفكر، بيروت)

ثلاثة معلمين كانوا بالمدينة يعلمون الصبيان، وكان عمر بن الخطاب يرزق كل واحد منهم خمسة عشر درهما كل شهر.

كتاب الأموال: ১/৩৩৩، دار الفكر، بيروت

حدثنا إبراهيم بن سعد، عن أبيه سعد بن إبراهيم: أن عمر بن الخطاب كتب إلى بعض عماله: أن أعط الناس على تعلم القرآن.

التراتيب الإدارية للكتاني: (১/২২৬—২২৭، دار الأرقم، بيروت)

هل كان للولاة والقضاة راتب؟ في >الهداية<: روي عنه أنه بعث عتَّاب بن أَسِيد إلى مكة وفرض له. قال الحافظ الزيلعي في >نصب الراية<: >غريب<. ثم ذكر عن ابن سعد في >الطبقات< أن عتَّابا قال: >ما أصبت منذ وليت عملي هذا إلا ثوبين كسوتهما مولاي كيسان<. اﻫ. ثم قال: وذكر أصحابنا أنه فرض له كل سنة أربعين أوقية، والأوقية أربعون درهما. وذكر أبو الربيع بن سالم أنه فرض له كل يوم درهما. وفي >طبقات ابن سعد<: أن عمر رزق عياض بن غنم حين ولاه جند حمص كل يوم دينارا وشاة ومدا.

وفي البخاري في باب رزق الحكام والعاملين عليها: >وكان شريح يأخذ على القضاء أجرا. وقالت عائشة: يأكل الوصي بقدر عمالته. وأكل أبو بكر وعمر<. اﻫ. وفي >مصنف عبد الرزاق<: الحسن بن عمارة عن الحكم أن عمر بن الخطاب رزق شريحا وسليمان بن ربيعة الباهلي على القضاء. اﻫ. وروى ابن سعد في >الطبقات<: بلغني أن عليا رزق شريحا خمسمائة.

وأن عمر بن الخطاب استعمل زيد بن ثابت على القضاء وفرض له رزقا.

ولما استخلف أبو بكر، أصبح غاديا إلى السوق، فلقيه (عمر) وأبو عبيدة، قالا: انطلق حتى نفرض لك شيئا. وأن أبا بكر لما استخلف جعلوا له ألفين، فقال: زيدونا فزادوه خمسمائة.

أقول: كان الحافظ الزيلعي والحافظ ابن حجر لم يستحضرا في هذا الموطن حديث أبي داود والحاكم عن بريدة رفعه: >أيما عامل استعملناه وفرضنا له رزقا، فما أصاب بعد رزقه فهو غلول<، عزاه لهما الحافظ في >التلخيص الحبير<. وقد وجدت أبا داود بوَّب عليه في أبواب الخراج والإمارة: باب في أرزاق العمال، ثم أخرجه بلفظ: >من استعملناه على عمل فرزقناه رزقا، فما أخذ بعد ذلك فهو غلول<، ثم أخرج عن المستورِد بن شداد رفعه: >من كان لنا عاملا فليكتسب زوجة، فإن لم يكن له خادم فليكتسب خادما، فإن لم يكن مسكن فليكتسب مسكنا<، قال: قال أبو بكر: أخبرت أن النبي قال: >من اتخذ غير ذلك فهو غالٌّ أو سارق<.

وفي >عون الودود< على الحديث الأول: >سكت عنه أبو داود والمنذري، ورجاله ثقات. وفيه بينةٌ على جواز أخذ العامل حقه من تحت يده، فيقبض من نفسه لنفسه<. ثم نقل عن الطيبي على الحديث الثاني: >فيه أنه يحل له أن يأخذ مما في تصرفه من بيت المال قدر مهر زوجته ونفقتها وكسوتها، وكذا ما لا بد له منه من غير إسراف وتنعُّم<. اﻫ.

ثم أخرج أبو داود عن ابن الساعدي قال: استعملني عمر على الصدقة، فلما فرغت أمر لي بعمالة (ما يأخذه العامل من الأجرة) فقلت: إنما عملت لله. فقال: خذ ما أعطيت؛ فإني عملتُ على عهد رسول الله ‘ فعمَّلني أي أعطاني عمالتي.

قال الكنكوهي في >التعليق المحمود على سنن أبي داود< عليه: >فيه جواز أخذ العوض من بيت المال على العمل العام، كالتدريس والقضاء وغيرهما، بل يجب على الإمام كفايةُ هؤلاء ومن في معناهم من بيت المال. وظاهر هذا الحديث وغيره مما يبين وجوب قبول ما أعطيه الإنسان من غير سؤال ولا إشرافِ نفسٍ، وبه قال أحمد وغيره، وحمل الجمهور على الاستحباب والإباحة<. اﻫ. انظر الباب ৪৯ من >سراج الملوك< والمُوَفِّي خمسين.

التراتيب الإدارية للكتاني: (২/১১১—১১৩، دار الأرقم، بيروت)

الفصل الأول في أن لكلِّ من شغل بشيء من أعمال المسلمين أخذ الرزق على شغله ذلك. روى البخاري رحمه الله تعالى (৯/৮৪—৮৫) عن عبد الله بن السعدي أنه قدم على عمر في خلافته، فقال له عمر: >ألم أُحدَّث أنك تلي من أعمال الناس أعمالا، فإذا أُعطيتَ العُمالة كرهتَها؟< فقلت: بلى. فقال عمر: >فما تريد إلى ذلك؟< فقلت: إن لي أفراسا وأعبُدا، وأنا بخير، وأريد أن تكون عمالتي صدقة على المسلمين، قال عمر: >لا تفعل؛ فإني كنت أردتُ الذي أردتَ، فكان رسول الله ‘ يعطيني العطاء فأقول: أعطه أفقر إليه منِّي، حتى أعطاني مرَّة ثانية، فقلت: أعطه أفقر إليه مني<، فقال النبي: >خذه فتموَّلْه وتصدق به، فما جاءك من هذا المال وأنت غير مُشْرف ولا سائل، فخذه وإلا فلا تتبعه نفسك<. انتهى.

قال ابن بطال: قال الطبري: >في هذا الحديث الدليل الواضح على أن لمن شغل بشيء من أعمال المسلمين: أخذ الرزق على عمله ذلك، وذلك كالولاة والقضاة وجُباة الفيء وعمال الصدقة وشبههم، لإعطاء رسول الله عمر العمالة على عمله الذي استعمله عليه. فكذلك سبيل كلِّ مشغول بشيء من أعمالهم له من الرزق على قدر استحقاقه عليه: سبيل عمر رضي الله تعالى عنه في ذلك<. انتهى.

>الفصل الرابع في أرزاق الخلفاء بعده ورضي عنهم

১— أبو بكر الصديق رضي الله تعالى عنه:

اختلف في ذلك، فذكر أبو الفرج ابن الجوزي في >صفة الصفوة< (১/৯৭) عن عطاء بن السائب قال: لما استخلف أبو بكر أصبح غاديا إلى السوق، وعلى رقبته أثواب يتَّجر بها، فلقيه عمر وأبو عبيدة بن الجراح رضي الله تعالى عنهم، فقالا: أنى تريد يا خليفة رسول الله؟ قال: السوق، قالا: أتصنع ماذا، وقد وليت أمر المسلمين! قال: فمن أين أطعم عيالي؟ قالا: انطلق حتى نفرض لك شيئا، فانطلق معهما، ففرضا له كل يوم شطر شاة وما كَسَوه في الرأس والبطن. وذكر عن حميد بن هلال قال: لما ولي أبو بكر، قال أصحاب رسول الله‘: افرضوا لخليفة رسول الله ما يغنيه، قالوا: نعم، بردان إذا أخلقهما، وضعهما وأخذ مثلهما، وظهره إذا سافر، ونفقته على أهله كما كان ينفق قبل أن يستخلف، قال أبو بكر: رضيت.

وذكر ابن هشام في >البهجة<، وابن الأثير في >تاريخه< (২/৪২৪): أن الذي فُرض له رضي الله تعالى عنه: ستة آلاف درهم في السنة. قال ابن هشام: ولما حضرته الوفاة قال: >ردُّوا ما عندنا من مال المسلمين<، فدفع إلى عمر بن الخطاب لَقُوح وعبد وقطيفة ما تساوي خمسة دراهم، فقال عمر رضي الله تعالى عنهما: لقد أتعبت مَن بعدك. وقال ابن الأثير (২/২৪২): ولما حضرته الوفاة أوصى أن تباع أرض له، ويُصْرف ثمنُها عوضَ ما أخذه من مال المسلمين.

২— عمر بن الخطاب رضي الله تعالى عنه:

ذكر ابن الأثير في >تاريخه< أن عمر بن الخطاب رضي الله تعالى عنه قال للمسلمين: >إني كنت امرأ تاجرا يغني الله عيالي بتجارتي، وقد شغلتموني بأمركم هذا، فما ترون أنه يحل لي في هذا المال؟ وعلي رضي الله تعالى عنه ساكت، فأكْثر القومُ، فقال: ما تقول يا علي؟ قال: ما أصلحك وأصلح عيالك بالمعروف، ليس لك غيره، فقال القوم: القول ما قاله علي، فأخذ قُوْته.

৩— معاوية بن أبي سفيان:

ذكر أبو عمر ابن عبد البر في >الاستيعاب< (৩/১৪১৬) عن سليمان بن موسى عن أبيه، أن عمر بن الخطاب رضي الله تعالى عنه رزق معاوية على عمله بالشام عشرة آلاف دينار في كلِّ سنة.

وذكر أيضا في الكتاب المذكور عن صالح بن الوجيه قال: في سنة تسع عشرة كتب عمر رضي الله تعالى عنه إلى يزيد بن أبي سفيان يأمره بغزو قَيْساريَّة، فغزاها وبها بَطَارقة الروم، فحاصرهم أياما، وكان بها معاوية أخوه فخلَّفه عليها، وسار يزيد يريد دمشق، فأقام معاوية على قَيْساريَّة حتى فتحها في شوال سنة تسع عشرة، وتوفي يزيد في ذي الحجة من ذلك العام في دمشق، واستخلف أخاه معاوية على ما كان يزيد يلي من عمل الشام، ورزقه ألف دينار في كل شهر، كذا قال صالح بن الوجيه. انتهى.

>ذكر أبو عمر ابن عبد البر في باب العبادلة من >الاستيعاب< (৩/৯৯৭، دار الجيل) عبدَ الله بن أم مكتوم الأعمى القرشي العامري، فقال نقلا عن الواقدي: >قدم المدينة مع مصعب بن عمير بعد بدر بيسير، فنزل دار القراء<. اﻫ. وفي ترجمة ابن أم مكتوم من >طبقات ابن سعد< (৪/১৫০): >قدم المدينة مهاجرا بعد بدر بيسير، فنزل دار القراء، وهي دار مخرمة بن نوفل< (التراتيب الإدارية: ১/১১২).

>باب من كان يعلم القرآن في المدينة، ومن كان يبعثه إلى الجهات لذلك، وحفاظ القرآن من الصحابة، ومعلِّم الناس الكتابة من الرجال والنساء مؤمنين وكافرين، والمفتين على عهده، ومعبِّري الرؤيا، واتخاذ الدار في ذلك الزمن ينزلها القراء كالمدارس اليوم وغير ذلك.< (التراتيب الإدارية: ২/২০২)

في >الاستبصار< لابن قدامة المقدسي: >لما قدم مصعب بن عمير المدينة، نزل على أسعد بن زُرارة، فكان يطوف به على دور الأنصار، يقرئهم القرآن ويدعوهم إلى الله عزَّ وجلَّ، فأسلم على يديهما جماعة، منهم: سعد بن معاذ وأُسَيد بن حُضَير، وغيرهما<. اهـ. (التراتيب الإدارية: ১/১০৪)

وقال الحافظ السخاوي: >من السلف الصالح من كان يتَّجر يقصد القيام بمؤونة من قصَر نفسه على بث العلم والحديث، ولم يتفرَّغ من أجل ذلك للتكسب لعياله، فعن ابن المبارك أنه كان يقول للفضيل بن عياض: لولا أنت وأصحابك —وعنى بهم السفيانَيْن وابن علية وابن السَّمَّاك— ما اتجرت<. اﻫ. (التراتيب الإدارية: ১/৩১৪)

أدب المفتي والمستفتي لابن الصلاح: (ص১৬২—১৬৩)

>وليس له التمذهب بمذهب أحد من أئمة الصحابة وغيرهم من الأولين، وإن كانوا أعلم وأعلى درجة ممن بعدهم، لأنهم لم يتفرغوا لتدوين العلم وضبط أصوله وفروعه، وليس لأحد منهم مذهب مهذَّب محرَّر مقرَّر، وإنما قام بذلك من جاء بعدهم من الأئمة الناخلين لمذاهب الصحابة والتابعين، القائمين بتمهيد أحكام الوقائع قبل وقوعها، الناهضين بإيضاح أصولها وفروعها، كمالك وأبي حنيفة وغيرهما<.

البرهان في أصول الفقه للجويني: (২/১৭৭)

>أجمع المحققون على أن العوام ليس لهم أن يتعلقوا بمذاهب أعيان الصحابة رضي الله تعالى عنهم، بل عليهم أن يتبعوا مذاهب الأئمة الذين سَبَروا، ونظروا، وبوَّبوا الأبواب، وذكروا أوضاع المسائل، وتعرَّضوا للكلام على مذاهب الأولين. والسبب فيه: أن الذين دَرَجوا وإن كانوا قدوة في الدين وأسوة للمسلمين؛ فإنهم لم يعتنوا بتهذيب مسالك الاجتهاد، وإيضاح طرق النظر والجدال، وضبط المقال. ومن خَلَفهم من أئمة الفقه كَفَوا مَن بعدهم النظرَ في مذاهب الصحابة، فكان العامي مأمورا باتباع مذاهب السابرين<.

نفائس الأصول في شرح المحصول للقرافي: (৯/৩৯৬৬)

(مسألة) قال إمام الحرمين في البرهان: أجمع المحققون على أن العوام ليس لهم أن يتعلقوا بمذهب أعيان الصحابة رضي الله عنهم، بل عليهم أن يتبعوا مذاهب الأئمة الذين سَبَروا، ونظروا، وبوَّبوا الأبواب، وذكروا أوضاع المسائل، وتعرَّضوا للكلام على مذاهب الأولين. والسبب فيه: أن الذين دَرَجوا وإن كانوا قدوة في الدين وأسوة للمسلمين؛ فإنهم لم يعْتَنوا بتهذيب مسالك الاجتهاد، وإيضاح طرق النظر والجدال، وضبط المقال. ومن خَلَفهم من أئمة الفقه كَفَوا مَن بعدهم النظرَ في مذاهب الصحابة، فكان العامي مأمورا باتباع مذاهب السابرين.

(…أن السابق) وإن كان له حق الوضع والتأسيس والتأصيل، فللمتأخر حق التكميل، وكلٌّ موضوعٌ على الافتتاح، فقد يتطرَّق إلى مبادئه بعضُ النسخ، ثم يتدرَّج المتأخر إلى التهذيب والتكميل، فيكون المتأخر أحق أن يتَّبَع لجمعه المذاهب، وبيانها. وهذا واضح في الحِرف والصناعات، فضلا عن العلوم ومسالك الظنون.

قلت: رأيت للشيخ تقي الدين ابن الصلاح ما معناه: أن التقليد يتعين لهذه الأئمة الأربعة، دون غيرهم من الصحابة رضي الله عنهم وغيرهم. وعلَّل ذلك بغير طريقة الإمام، وقال: إن مذاهب هؤلاء انتشرتْ وانبسطتْ، حتى ظهر فيها تقييد مطلقها، وتخصيص عامها، وشروط فروعها.

كتاب القصاص والمذكرين لابن الجوزي: (ص২৯৫، ১৭৯—১৮০، المكتب الإسلامي، بيروت)

>لما كان الخِطاب بالوعظ في الأغلب للعوام، وجدَ جهال من القصاص طريقا إلى بلوغ أغراضهم، ثم ما زالت بِدَعهم تزيد حتى تَفاقَم الأمر، فأتوا بالمنكرات في الأفعال والأقوال والمقاصد<.

>ينبغي للواعظ أن يكون حافظا لحديث رسول الله، عارفا بصحيحه وسقيمه، ومسنَده ومقطوعه ومعضَله، عالما بالتواريخ وسِيَر السلف، حافظا لأخبار الزهاد، فقيها في دين الله، عالما بالعربية واللغة، فصيح اللسان. ومدار ذلك كله على تقوى الله عز وجل<.

>لا ينبغي أن يقُصَّ على الناس إلا العالمُ المتقنُ فنونَ العلوم؛ لأنه يُسأل عن كل فن. فإن الفقيه إذا تصدَّر لم يكد يُسأل عن الحديث، والمحدث لا يكاد يسأل عن الفقه، والواعظ يسأل عن كل علم، فينبغي أن يكون كاملا…

قال ابن قتيبة: >القصاص يميلون وجوه العوام إليهم ويستدِرُّون ما عندهم بالمناكير والغريب والأكاذيب من الأحاديث، ومن شأن العوام: القعود عند القاص ما كان حديثه عجيبا خارجا عن فِطَر العقول< (مقدمة التحقيق لكتاب القصاص والمذكرين، ص৮৯).

সুত্রসমূহ

দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে প্রকাশিত উর্দু পিডিএফ ফতওয়া দেখতে নিচের ডাউনলোড লিংকে ক্লিক করুন।

ডাউনলোড লিংক

والله اعلم بالصواب

দারুল ইফতা, রহমানিয়া মাদরাসা সিরাজগঞ্জ, বাংলাদেশ।

Loading

Scroll to Top