ফতওয়া কোডঃ 201-আ,মামা-28-11-1444
প্রশ্নঃ
দারুল উলুম দেওবন্দের পক্ষ থেকে মাওলানা সাদ সাহেবের ব্যাপারে সর্বশেষ ফতওয়া জানতে চাই, এবং এ ব্যাপরে আপনাদের মতামতও জানতে চাই।
সমাধানঃ
بسم اللہ الرحمن الرحیم
গত ১৮ জুন ২০২৩ ইং মুতাবিক ২৮ যিলকদ ১৪৪৪ হিজরিতে মাওলানা সাদ সাহেব সম্পর্কিত একটি ইস্তিফতার উত্তরে দারুল উলূম দেওবন্দ ভারতের ফতওয়া বিভাগ থেকে একটি ফতওয়া প্রকাশিত হয়, রহমানিয়া ইমাদদুল উলুম মাদরাসা সিরাজগঞ্জ, বাংলাদেশ এর কেন্দ্রীয় দারুল ইফতার সম্মানিত মুফতি সাহেবগন উক্ত ফতওয়ার সাথে একমত পোষণ করেছেন, নিচে পুরো ফতওয়া উল্লেখ করা হলো।
প্রশ্ন নং : 11360-805/B=11/1444
بسم اللہ الرحمن الرحیم
শ্রদ্ধেয় হযরত মাওলানা মুফতি আবুল কাসেম নুমানি দামাত বারাকাতুহুম ও দারুল উলূম দেওবন্দের সকল সম্মানিত মুফতি বরাবর
আস সালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।
আপনাদের সকাশে নিবেদন হলো, তাবলীগ জামাতের একজন পরিচিত ও উঁচু পদের যিম্মাদারের পক্ষ থেকে অজ্ঞতাপূর্ণ কথা দিনদিন বেড়েই চলেছে। আমরা রমাযানের পূর্বে ভূপাল ইজতিমা ২০২২ ই. আলেমদের মজলিসের বয়ান আপনাদেরকে জানিয়েছিলাম। যা পড়ে আপনারা মে․খিকভাবে আফসোস ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো লিখিত উত্তর পাইনি। সম্প্রতি এপ্রিল ২০২৩ ই. এর নতুন বয়ান সামনে এসেছে। সেই বয়ানে তিনি উলামায়ে কেরাম ও মাদরাসার পরিচালকদেরকে দ্বিধায় ফেলে দিয়েছেন। আমরা হতভম্ব যে, একজন লোক গোটা দুনিয়ার সকল আলিম ও বুজুর্গদেরকে ধিক্কার দিয়ে বলছেন যে, ব্যবসা করাটা আলিমদের জন্যে জনসাধারণ অপেক্ষা অধিক জরুরি। দ্বীনের খাদিমদের দায়িত্ব হলো, নিজের ভরণ-পোষণের বন্দোবস্ত নিজেই করা। এর অন্যথা হলে দ্বীনের জন্যে তাদের সকল চেষ্টা-সাধনা ত্রুটিপূর্ণ। জনগণ ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পালন করবে, এটি ভুল ধারণা।
তিনি পরিস্কার শব্দে এ কথা বলেছেন
“রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেকে এবং তাঁর খুলাফায়ে রাশেদিনকে এভাবে অভ্যস্ত করেছিলেন যে, তোমাদের কাছে কোনো সম্পদ এলে প্রত্যাখ্যান করবে। তোমাদের দ্বীনি খিদমতের কারণে তোমাদের কাছে কোনো সম্পদ পেশ করা হলে তা গ্রহণ করবে না। সাহাবায়ে কেরাম জানতেন না যে, পারিশ্রমিক ও সাওয়াব কীভাবে একত্র হতে পারে! অথচ এ যুগের লোকেরা বলে যে, সাওয়াবও পাবে, আবার পারিশ্রমিকও পাবে। অথচ সাহাবায়ে কেরাম জানতেন না যে, দ্বীনের কোনো খিদমতের জন্যে পারিশ্রমিক নিলে আমাদের সাওয়াব বাকি থাকবে। সাহাবায়ে কেরাম তা জানতেন না। পরবর্তী যুগের লোকেরা তাবিল (অপব্যাখ্যা) করে নিজেরা অভাবমুক্ত হওয়া সত্ত্বেও দ্বীনের খিদমতের জন্যে পারিশ্রমিক গ্রহণ করার অভ্যাস বানিয়ে ফেলেছে। অভাবমুক্ত হওয়া সত্ত্বেও এ কাজ করছে। অথচ সাহাবায়ে কেরাম অভাবী হওয়া সত্ত্বেও দ্বীনি খিদমতের ওপর বিনিময় গ্রহণ করতেন না।
অথচ এ যুগের লোকেরা এটাকে অভ্যাস বানিয়ে ফেলেছে। আমি মনে করি, একজন শিক্ষক মাদরাসায় পড়ানোর পাশাপাশি ব্যবসা করবেন। যারা মাদরাসায় পড়ান না, তাদের ব্যবসা করার তুলনায় মাদরাসা শিক্ষকদের ব্যবসা করা অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি। প্রত্যেক শিক্ষক, মুহাদ্দিস, আমির ও মুবাল্লিগ নিজেদের দ্বীনি খিদমতের পাশাপাশি ব্যবসা করবেন। যেসব সাধারণ অজ্ঞ মানুষ কোনো সম্মিলিত কাজের দায়িত্ব পালন করছেন না, তাদের ব্যবসা করার তুলনায় আলিমদের ব্যবসা করা অধিক জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ জনগণের জন্যে ব্যবসা করাটা ততটা জরুরি নয়। বুজুর্গানে দ্বীন, উলামা ও মুবাল্লিগগণ দুনিয়াবি কাজে লিপ্ত হলে দ্বীনের মাঝে ব্যঘাত সৃষ্টি হবে জানি না, কোত্থেকে এই মানসিকতা গড়ে উঠেছে! কোত্থেকে এই বিষয় সৃষ্টি হয়েছে! অথচ আমি মনে করি, এর ফলে তাদের মেহনতের সহায়ক হবে।
আজ তারা কিতাব থেকে ব্যবসা সংক্রান্ত অধ্যায় পড়াচ্ছেন। অথচ তার থেকে উত্তম হলো, তারা নিজেরাই বাজারে বসে উম্মতকে প্র্যাক্টিক্যাল ব্যবসা শেখাবেন। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো, এ যুগে কাফেরদের মতো মুসলমানরাও আলিম ও বুজুর্গদের ব্যবসা করাকে দুষণীয় মনে করে। যেভাবে কাফেররা নবিদের কোনো পার্থিব কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়াকে অপরাধ মনে করতো, এ যুগের মুসলমানরাও তদ্রƒপ আলিম ও বুজুর্গদেরকে কোনো বাণিজ্যিক বা কোনো পার্থিব কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়াকে দোষ মনে করে। আমি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছি। একজন মাদরাসা শিক্ষকের ব্যবসা করা একজন নন-আলিম ব্যক্তির ব্যবসা করা থেকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি। কারণ দুটি। যেন তারা সৃষ্টিজীব থেকে অমুখাপেক্ষী হয়ে দ্বীনের খিদমত করতে পারেন। দ্বিতীয় যে কারণটি বলছি, তা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তা হলো আবু বকর রাদি. এর আমল।
(তিনি বলেছিলেন,) ‘খিলাফতের দায়িত্ব আমাকে ব্যবসা থেকে বাঁধা দিতে পারবে না।’ আপনি ভেবে দেখুন। সকল মুসলমানের সমস্ত যিম্মাদারি তাঁর ওপর। যত দূর ইসলাম ছড়িয়েছে, সেখানকার সকল মুসলমানের তিনি আমির। তাহলে তার যিম্মাদারিতে কত বেশি কাজ হতে পারে! এত বেশি ব্যস্ততা সত্ত্বেও তিনি ব্যবসা করাকে খিলাফতের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক মনে করছেন না। এটাকে দোষ মনে করছেন না। হযরত উমর রাদি. আপত্তি তুলে বলেছিলেন যে, আপনার ব্যবসা খিলাফতের দায়িত্ব পালনে বিঘ্ন হবে। তিনি উত্তরে বলেন, ‘কীভাবে বিঘ্ন হবে? আমি এই দায়িত্বও পালন করব, ব্যবসাও করব।’ আলিমদের ব্যবসা করার আরেক কারণ হলো, তারা যেন বাজারঘাটে যান, আইন-আদালতে যান। ব্যাংকিংসহ পৃথিবীর সকল শাখায় প্রবেশ করেন, যেন পার্থিব সকল শাখায় মুসলমানগণ তাদের সাথে প্র্যাক্টিক্যাল যোগাযোগ করে। এখন যে স্রেফ কিতাবি সম্পর্ক আছে, আমি তাকে দ্বীনের জন্যে যথেষ্ট মনে করি না। কিতাবি শিক্ষা কখনই প্র্যাক্টিক্যাল শিক্ষা নয়। আপনারা ননপ্র্যাক্টিক্যাল শিক্ষাকেই একমাত্র শিক্ষা মনে করে বসে আছেন। কথাগুলো বুঝতে পারছেন? কিতাবি শিক্ষার মতো ননপ্র্যাক্টিক্যাল শিক্ষাকেই একমাত্র শিক্ষা মনে করে বসে আছেন। শিক্ষাকে অব্যবহারিক করে রেখেছেন।
হযরত উমর রাদি. এর শাসনামলে কারো জন্যে এই অনুমতি ছিল না যে, ব্যবসার বিষয়াদি ও তৎসংশ্লিষ্ট বিধি-বিধানের পরীক্ষা না দিয়ে কেউ মদিনাতে দোকান খুলবে। আমরা তো মুসলমানদেরকে নামায-রোযা শেখাতে চাই। আমরা তাদেরকে ইসলামি ব্যবসা দেখাতে চাই। মদিনায় এসে ব্যবসার ইসলামি পদ্ধতি দেখে যাও। এজন্যে আমি নিবেদন করছি যে, ছাত্র বা শিক্ষক- প্রত্যেকের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব অন্য কেউ নেবেÑ এটা ভুল ভাবনা। আমি মনে করি, এর ফলে ছাত্র ও শিক্ষক, উভয়ের মুজাহাদা ত্রুটিপূর্ণ হয়ে যায়। শিক্ষকের মুজাহাদাও ত্রুটিপূর্ণ। ছাত্রের মুজাহাদাও ত্রুটিপূর্ণ। তারা তো খুশি যে, সমাজের ধনী ব্যক্তিরা আমাদের সকল প্রয়োজন পূরণের যিম্মাদারি পালন করছেন। কাজেই আমাদের কিছু করার কী প্রয়োজন! শিক্ষাকও খুশি, ছাত্রও খুশি। শরিয়তের মূল উত্তম বিধান (আজিমত) যখন খতম হয়ে যায় তখন রুখসত (জায়েজ ছাড় বিধান)-ই প্রত্যেকের অভ্যাসে পরিণত হয়।
এখন কেউ আজিমতের বয়ান দিলে মানুষ মনে করে, সে বুঝি রুখসতের বিধানকে অস্বীকার করছে। এজন্যে তারা বরদাশত করতে পারে না। তারা মনে করে, আমাদের খণ্ডন করা হচ্ছে। আসলে এটি আপনাদের খণ্ডন নয়; বরং মূল বিধানের দিকে আপনাদের মনোযোগ আকর্ষণ জরুরি। আমার বক্তব্য হলো, শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণের পাশাপাশি নিজের সকল প্রয়োজন পূরণের নিজেই যিম্মাদার হওয়া সাহাবায়ে কেরামের, খুলাফায়ে রাশেদিনের, সকল নবি-রাসূলের ক্সবশিষ্ট্য। এটি শুধু জরুরতই নয়; সিফাত (ক্সবশিষ্ট্য)। জরুরত তো যেনতেনভাবে পূরণ হয়ে যাবে। আমি বলি, এটি হলো সিফাত যে, নবিগণ ব্যবসা করতেন। প্রত্যেক নবির কোনো না কোনো পেশা ছিল। কেউ লে․হকার ছিলেন। কেউ কাঠমিস্ত্রি ছিলেন। এ যুগের মুসলমানরা যেসব কাজকে দোষ মনে করে, নবিগণ সেসব কাজ করেছেন। অথচ সেগুলোকে এ যুগে দোষ মনে করা হয়। আপনারা আজ এমন স্থানে পৌছে গেছেন যে, শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি কোনো ভালো ব্যবসা করাকেও আপনারা দোষ মনে করছেন!” (হায়াতুস সাহাবার তালিম, ২৯ এপ্রিল ২০২৩ ই.)
হে শীর্ষস্থানীয় উলামা হযরাত, তার এই বয়ান মারাত্মক গুমরাহি সৃষ্টিকারী মনে হচ্ছে। এর মাধ্যমে বয়ানকারী ব্যক্তি জনগণকে পরিস্কার এই অনুভূতি দিচ্ছেন যে, সমগ্র পৃথিবীতে তিনি একাই আজিমত (শরিয়তের মূল উত্তম বিধান) এর দিকে আহবান করছেন। এজন্যে আলিমগণ তার বিরোধিতা করছেন। আপনারা নিন্দুকের নিন্দার ভয় এড়িয়ে পূর্বেও একটি বড় পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। একটি সর্বসম্মত ফতোয়া জারি করেছিলেন। পরবর্তীতে আরেকটি লেখায় লিখেছিলেন যে, তিনি একটি নতুন দল বানাচ্ছেন। কিন্তু দারুল উলুম দেওবন্দের শত্রু, কতিপয় অদূরদর্শী লোক দারুল উলূম দেওবন্দ ও আমাদের আকাবিরের ওপর বেহুদা অপবাদ আরোপের মিশন শুরু করে দিয়েছিল। পর্ব আকারে প্রবন্ধ লিখেছে।
আমরা দেওবন্দের আকাবিরদের ওপর পূর্ণ আস্থা লালন করি যে, তারা হকের ব্যাপারে কখনই কারো দ্বারা প্রভাবিত হন না। আমরা আপনাদের কাছে ইতোপূর্বে আরো অনেকগুলো বয়ান পেশ করেছি। যার কোনোটায় আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের শানে বেয়াদবি হয়েছে। কিছু বয়ানে এই দাবি তোলা হয়েছে যে, বর্তমান সময়ের শিক্ষাদান ও দ্বীনের দাওয়াতের পদ্ধতি সুন্নাতপরিপন্থী। সেগুলো নিরীক্ষণ করার পর আপনাদের কাছে নিম্নোক্ত প্রশ্নগুলোর উত্তর প্রত্যাশা করছি।
(১) বয়ানকারীর উক্ত বয়ানগুলো কি শরিয়তের আলোকে সঠিক? এমন ব্যক্তির বিভ্রান্তিকর কথা কি অন্যদের কাছে পৌছানো ও প্রচার করা জায়েয?
(২) যারা এমন ব্যক্তির পক্ষে কথা বলে এবং ভুল দলিল সরবরাহ করে, তাদের ব্যাপারে শরিয়ত কী বলে?
(৩) কিছু লোক জনগণকে বোঝাচ্ছে যে, দারুল উলূম দেওবন্দের লোকজন সবসময় তাবলীগের বিরোধী ছিল। দারুল উলূম দেওবন্দ কি বাস্তবেই তাবলীগের বিরোধী? আমরা এই প্রশ্নগুলোর স্পষ্ট শব্দে উত্তর চাই। আমরা আপনাদেরকে এই তথ্য জানাতে চাই যে, দারুল উলুম দেওবন্দের দ্ব্যর্থহীন অবস্থান সামনে না আসার কারণে উলামায়ে কেরাম দ্বীনি পথপ্রদর্শনের ক্ষেত্রে নানাবিধ জটিলতার মুখোমুখি হচ্ছেন। অনেক ইমামের ইমামতি চলে যাচ্ছে। সব জায়গায় অস্পষ্ট ও পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা ছড়িয়ে পড়ছে। কেউ বলছে, ‘তিনি রুজু করেছেন। এজন্যে আমরা নিরুপায়। অতএব, আবারও দারুল উলুম দেওবন্দের শরণাপন্ন হোন। এই মাদরাসাই আমাদের জন্যে হককে হক হিসেবে চেনা ও বাতিলকে বাতিল হিসেবে জানার সবচেয়ে বড় কেন্দ্র।’ এজন্যে আমরা পরিস্কার শব্দে উল্লেখিত প্রশ্নগুলোর উত্তর চাই। আমাদের অনুভূতি ভুল হলে যেন সেই ভুলগুলো চিহ্নিত করে দেওয়া হয়। ওয়াস সালাম।
ফতোয়া জিজ্ঞেসকারী
১. আবদুর রশিদ। উসতায, মাদরাসায়ে যিয়াউল উলুম, মধ্যপ্রদেশ
২. মুহাম্মাদ খালেদ। উসতায, মাদরাসা আরাবিয়্যা, এমপি
৩. রফিক আহমদ। উসতায, দারুল উলূম মুহাম্মাদিয়া, এমপি
৪. মাওলানা মুফতি যিয়াউল্লাহ খান, শাইখুল হাদিস, জামিয়া ইসলামিয়া, ভুপাল
৫. যুবাইর আহমদ কাসেমি, উসতায, দারুল উলুম বাংলাওয়ালি
৬. জুনাইদ আহমদ কাসেমি, উসতায, দারুল উলূম সাগার, এমপি
৭. মুফতি ইনসাফ, উসতায, আনওয়ারুল উলূম ভুপাল
৮. মৌলভি যুবাইর, উসতায, উক্ত মাদরাসা
৯. মুহাম্মাদ ইরফান আলম কাসেমি, উসতায, ইরফানুল হুদা, ভুপাল
১০. মুহাম্মাদ আবরার, উসতায, যিয়াউল উলুম, এমপি
১১. মুহাম্মাদ মাহবুব কাসেমি, মুফতি, রাহাতগড়, সাগার, এমপি
১২. মুহাম্মাদ যুহাইর, কাজি, মধ্যপ্রদেশ
১৩. মুহাম্মাদ রিযওয়ান কাসেমি, উসতায, দারুল ইফতা, জামেয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া মসজিদে তরজমাওয়ালী, ভুপাল
উত্তরঃ 620801
بسم اللہ الرحمن الرحیم
الجواب، وبالله التوفيق
দারুল উলুম দেওবন্দ সর্বশেষ লেখায় (৩১ জানুয়ারি ২০১৮ ই. তারিখে প্রচারিত) আলোচিত ব্যক্তির চিন্তা-চেতনা ও মতাদর্শ সম্পর্কে লিখেছিল যে,
“দারুল উলূম দেওবন্দ নিজ অবস্থান ব্যক্ত করার সময় আলোচিত ব্যক্তির যেই মতাদর্শিক স্খলনের ওপর আফসোস প্রকাশ করেছিল, তা উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। কারণ, একাধিকবার তিনি রুজু করার পরেও নানা সময় তার থেকে এমন নিত্যনতুন বয়ান আমাদের কাছে পৌছেছে, যার মাঝে পূর্বের সেই মুজতাহিদসুলভ আন্দাজ, ত্রুটিপূর্ণ দলিল উপস্থাপন এবং দাওয়াত সম্পর্কে তার একান্ত নিজস্ব চিন্তাধারার ওপর শরিয়তের কথামালার ভুল প্রয়োগ প্রকাশ পেয়েছে। যার কারণে শুধুমাত্র দারুল উলূম দেওবন্দের উসতাযগণই নন; অন্যান্য হকপন্থী আলিমগণও তার সামগ্রিক চিন্তাধারার ওপর মারাত্মক আস্থাহীন। আমরা মনে করি, আমাদের আকাবির রহিমাহুল্লাহর চিন্তাধারা থেকে সামান্যতম বিচ্যুতিও মারাত্মক ক্ষতিকর। তাকে অবশ্যই নিজ বয়ানের ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে। পূর্বসূরিদের পদ্ধতি অনুসরণ করে শরিয়তের কথামালা থেকে ব্যক্তিগত ইজতিহাদের এই কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। কেননা তার এসব অদূরদর্শী ইজতিহাদ ও উদ্ভাবন দেখে মনে হচ্ছে “আল্লাহ না করুন” তিনি এমন একটি নতুন দল গঠন করতে উঠে-পড়ে লেগেছেন, যারা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ, বিশেষ করে নিজ পূর্বসূরিদের মতাদর্শ থেকে ভিন্ন।”
এই লেখা প্রকাশ করার পর থেকে অদ্যাবধি দারুল উলূম দেওবন্দের উসতাযদের কাছে সময়ে-অসময়ে এমনসব বয়ান পৌছেছে, যা পড়ে নির্দ্বিধায় এ কথা লেখা যায় যে, তিনি নিজেকে সংশোধন তো করেননি; উল্টো ভুল ইজতিহাদ, দ্বীন ও শরিয়তের বিকৃতি এবং মনগড়া দৃষ্টিভঙ্গির ওপর অবিচল থাকার প্রবণতার দিকে তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন। ভুপালের আলেমদের পক্ষ থেকে নিকট অতীতের যেসব তাজা বয়ান আমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে, (যার মাঝে ১৩ মে ২০২৩ ই. বাদ ফজরের বয়ানও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।) সেখানে দারুল উলুম দেওবন্দের উল্লেখিত বস্তুনিষ্ঠ অবস্থান সত্য প্রমাণিত হয়েছে যে, বিষয়টি ব্যক্তির কোনো আংশিক বিচ্যুত বয়ান নয়; বরং তিনি ক্সচন্তিক বক্রতা, ইলমের স্বল্পতা ও যোগ্যতাশূন্য হওয়া সত্ত্বেও ইজতিহাদ ও আবিস্কার করার দুঃসাহস দেখিয়ে চলেছেন।
যার ফলে তার মাধ্যমে দ্বীনবিকৃতির এটি স্বতন্ত্র ধারা চালু হয়েছে। এরচেয়েও অধিক বিপদজনক বিষয় হলো, তার অনুসারীরা সেই বিভ্রান্ত মতাদর্শের পক্ষে ভিত্তিহীন দলিল-প্রমাণ সোশ্যাল মিডিয়ায় দেদারছে প্রচার করে বেড়াচ্ছে। দারুল উলুম দেওবন্দ ও সেখানকার আসাতিযায়ে কেরামের বিরুদ্ধে নানা মিথ্যা দাবি ও অজ্ঞতাপ্রসূত কথাবার্তা জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার মিশন চালিয়ে যাচ্ছে। এতদিন আমরা এসব কার্যকলাপ উপেক্ষা করেছি। কিন্তু যখন দেখা গেল যে, জমহূর তথা সংখ্যাগরিষ্ঠ উম্মাহর বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য ও অজ্ঞতাপ্রসূত কথাবার্তা জনগণের মাঝে ব্যাপকাকারে ছড়ানো হচ্ছে; জনগণের সামনে আমাদের আকাবির রহিমাহুল্লাহর মতাদর্শের সুস্পষ্ট ভুল ব্যাখ্যা করা হচ্ছে; ‘সিরাতে সাহাবা’ শিরোনাম দিয়ে সোনালি যুগের ভুল ও মনগড়া চিত্র উম্মতের সামনে উপস্থাপন করা হচ্ছে এবং সেসব বিভ্রান্তিকর কথাগুলো মসজিদে মসজিদে প্রচার-প্রসার করা হচ্ছে, তখন উম্মতকে গুমরাহি থেকে বাঁচানোর জন্যে বিশুদ্ধ এবং সুস্পষ্ট ভাষায় অবস্থান ব্যক্ত করা নিঃসন্দেহে একটি অনিবার্য দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রশ্নের মাঝে ২৯ এপ্রিল ২০২৩ তারিখের যেই বয়ান নকল করা হয়েছে, তার পূর্ণাঙ্গ নিরীক্ষণের পূর্বে এ কথা সুস্পষ্ট করা জরুরি যে, দ্বীনের খিদমতে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ সম্পর্কে সেই বয়ানকারী (মাওলানা সাদ সাহেব) নিজস্ব যেই খেয়াল প্রকাশ করেছেন, এটি তার কোনো নতুন বা প্রথম দ্বীনবিকৃতি নয়; দারুল উলূম দেওবন্দ ও অন্যান্য হকপন্থী উলামায়ে কেরামের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে পূর্বেও সতর্ক করা হয়েছে। এতদসত্ত্বেও তিনি জনসাধারণের মজলিসে নিজের সেই গুমরাহ চিন্তাধারা কোনো না কোনো শিরোনামের অধীনে ধারাবাহিকভাবে চর্বিত চর্বণ করে যাচ্ছেন। কিন্তু প্রশ্নে উল্লেখিত বয়ান তার পূর্বের সকল বয়ানের তুলনায় অধিক বিপদজনক।
কারণ, তিনি এখানে উলামা, মুহাদ্দিসিনে কেরাম, বুজুর্গানে দ্বীন ও দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জনগণ কর্তৃক ভরণ-পোষণের প্রচলিত পদ্ধতিকে সুস্পষ্ট শব্দে অপদস্থ করার চেষ্টা করেছেন। এ কথা স্পষ্ট যে, বয়ানকারী দ্বীনের খিদমতে শতভাগ নিয়োজিত ব্যক্তিদেরকে যেসব ভিত্তিতে (সাহাবায়ে কেরামের সিরাতের অনুসরণ, জনগণ থেকে অমুখাপেক্ষী থাকা, পরিপূর্ণ মুজাহাদা করা, জনগণকে প্র্যাক্টিক্যাল ব্যবসা শেখানো এবং দ্বীনি কাজকর্মে সহায়তা অর্জন করা) ব্যবসা ও জীবিকা উপার্জন করার ওপর উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং জনগণের সামনে এই অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন যে, ছাত্র-শিক্ষক ও দ্বীনের সেবকদের জীবিকার সংস্থান ও ব্যয়ভার নির্বাহের প্রচলিত পদ্ধতি সাহাবায়ে কেরামের সিরাতের পরিপন্থী; তার এসব ভিত্তি ও অনুভূতি শতভাগ ভুল। ভিত্তি যেমন ভুল, তেমনি সীরাতের বাহানা দেওয়াটাও অজ্ঞতাপ্রসূত কথা।
সঠিক তথ্য হলো, যেসকল সাহাবি সাধারণ মুসলমানদের দ্বীনি প্রয়োজন পূরণের খিদমতে জড়িত ছিলেন, তাদের জীবিকার দায়িত্ব তখনকার জনগণ পালন করতেন। এটাই ছিল সেই যুগের প্রচলিত পদ্ধতি। বাইতুল মাল থেকে তাদের বেতনভাতা নির্ধারিত ছিল। দ্বীনের সেই সেবকগণ নিজেদের জীবিকার সংস্থানের জন্যে বাইতুল মালের ভাতা গ্রহণ করতেন। আল্লামা আইনি রহ. এর ভাষ্য অনুসারে, সাহাবায়ে কেরামের যুগে এমন ব্যক্তিবর্গের জন্যে ভাতা চালু করা ইজমা’ তথা সর্বসম্মত বিধান ছিল। তারা অন্যদের মতো ব্যবসা-বাণিজ্য না করে জনগণের ভরণ-পোষণ মঞ্জুর করেছিলেন এ কারণে যে, এসব ব্যক্তিবর্গ ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িত হয়ে পড়লে দ্বীনের খিদমত যথাযথভাবে পালন করতে ব্যঘাত ঘটবে।
এ সম্পর্কে শত শত মুহাদ্দিস, ফকিহ ও জীবনীকারদের সুস্পষ্ট লেখা এত প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান রয়েছে যে, সবগুলো এখানে তুলে ধরা দুরুহ। আমরা নমুনা হিসেবে কয়েকটি উদ্ধৃতি পেশ করছি― সবার আগে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদি. এর সেই পূর্ণ ঘটনা ’যার ওপর ভিত্তি করে বয়ানকারী তার ভুল আবিস্কার (ইজতিহাদ) হাজির করেছেন’ তার সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণের ব্যাখ্যা দেখুন। হায়াতুস সাহাবার (২/৫১৬) মাঝে সেই ঘটনার বিবরণ হলো
رد أبي بكر الصديق رضي الله عنه المال
(قصة ردّه رضي الله عنه وظيفته من بيت المال)
أخرج البيهقي عن الحسن أن أبا بكر الصديق رضي الله عنه خطب الناس فحمد الله وأثنى عليه ثم قال: إن أكيس الكيس التقوى – فذكر الحديث، وفيه: فلما أصبح غدا إلى السوق فقال له عمر رضي الله عنه : أين تريد؟ قال: السوق، قال: قد جاءك ما يشغلك عن السوق، قال: سبحان الله يشغلني عن عيالي! قال: تفرض بالمعروف ؛ قال : ويخ عمرا إني أخاف أن لا يسعني أن أكل من هذا المال شيئاً. قال: فأنفق في سنتين وبعض أخرى ثمانية آلاف درهم، فلما حضره الموت قال قد كنت قلت لعمر: إني أخاف أن لا يسعني أن أكل من هذا المال شيئاً، فغلبني ؛ فإذا أنا من فخذوا من مالي بثمانية آلاف درهم وردوها في بيت المال! قال: فلما أتي بها . الله أبا بكر، لقد أتعب من بعده تعباً شديداً
السنن الكبرى ٣٥٣/٦
طبقاته ١٩٦/٣
দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে প্রকাশিত উর্দু পিডিএফ ফতওয়া দেখতে নিচের ডাউনলোড লিংকে ক্লিক করুন।
সুত্রসমূহ
والله اعلم بالصواب
দারুল ইফতা, রহমানিয়া মাদরাসা সিরাজগঞ্জ, বাংলাদেশ।