পেনশনের টাকা ইসলামি ব্যাংকে রেখে ইন্টারেস্ট খাওয়া হালাল নাকি হারাম? তাহলে এই ব্যক্তি রিটায়ার্ড করেছে ১৫ লাখ টাকা দিয়ে সে এখন কি করবে?এখন তো তার ব্যাবসা করার বয়স ও নেই। মুফতি সাহেবের নিকট দলিল সহ জানতে চাই।
সমাধানঃ
بسم الله الرحمن الرحيم
উলামায়ে কিরামের তাহকীক মতে ইসলামী ব্যাংক শরয়ী ব্যবসানীতি পুরোপুরি অনুসরন করে না। তাই তাদের কাছে জমা রাখা টাকার লভ্যাংশ সুদ হিসেবেই ধর্তব্য হবে, যা সম্পূর্ণ হারাম। এখন তার নিজের পক্ষে ব্যবসা করা সম্ভব না হলে অন্যের সাথে مشاركة (মুশারাকা) অথবা مضاربة (মুদারাবা) এর ভিত্তিতে ব্যবসা করতে পারে বা নিজে কোনো ব্যবসা আরম্ভ করে লোকের মাধ্যমে ও পরিচালনা করতে পারে।
১. “মুশরাকা” মূলত আরবী শব্দ। যার আভিধানিক অর্থ শরীক বা অংশীদার হওয়া। কারবার ও ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিভাষায় মুশারাকা বলতে এমন এক যৌথ কারবারকে বুঝায়, যে কারবারে সকল অংশীদার যৌথ কারবারের লাভ লোকসানে শরীক থাকে। মুশারাকা বা অংশীদারি কারবার সুদভিত্তিক অর্থায়নের একটি আদর্শিক বিকল্প ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় সম্পদ উৎপাদন ও বণ্টন উভয়ের সাথে অংশীদারগণ জড়িত থাকে। আধুনিক পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থায় সুদই একমাত্র মাধ্যম যাকে সর্বপ্রকারের অর্থায়নের ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ইসলামে যেহেতু সুদ হারাম, সেহেতু একে কোন ধরনের অর্থায়ন (Financing) এর জন্য ব্যবহার করা যায় না। এজন্য ইসলামী মূলনীতিভিত্তিক অর্থ-ব্যবস্থায় ‘মুশারাকা’ সময়ের দাবী পূরণে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করতে সক্ষম।
২. “মুদারাবা” অংশীদারিত্বের একটি বিশেষ পদ্ধতি। যে অংশীদারিত্বে এক শরীক অপরকে ব্যবসায় বিনিয়োগের জন্য অর্থ সরবরাহ করে। পুঁজি বিনিয়োগ করে প্রথম পক্ষ, তাকে বলা হয় “রাব্বুলমাল” বা “পুঁজি বিনিয়োগকারী” অপরদিকে ব্যবসার পরিচালনা (Management) এবং কাজের দায়িত্ব দ্বিতীয় পক্ষের উপর, যাকে বলা হয় “মুদারিব” বা “কারবারি”।
মুশারাকা এবং মুদারাবার মাঝে পার্থক্য নিম্ন-বর্ণিত দিকগুলোতে সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করা যায়।
(১) মুশারাকায় পুঁজি উভয়পক্ষ থেকে সরবরাহ করা হয়। কিন্তু মুদারাবায় পুঁজি বিনিয়োগের দায়িত্ব শুধু রাব্বুল মালের উপর।
(২) মুশারাকায় সকল অংশীদারগণ ব্যবসার জন্য কাজ করতে পারে এবং ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনায় (Management) সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে। কিন্তু মুদারাবায় রাব্বুলমাল ব্যবস্থাপনায় অংশ গ্রহণের কোন অধিকার রাখেনা, বরং তা শুধুমাত্র মুদারিবই আঞ্জাম দিবে।
(৩) মুশারাকায় সকল অংশীদার স্বীয় পুঁজির পরিমাণ অনুপাতে লোকসানে অংশীদার হয়। কিন্তু মুদারাবায় যদি লোকসান হয়, তাহলে তা শুধুমাত্র রাব্বুলমালকেই বহন করতে হবে। কেননা, মুদারিবতো কোন মূলধনই বিনিয়োগ করে না। তার লোকসান শুধুমাত্র এতটুকু যে, শ্রম বিফলে গেল এবং কোন পারিশ্রমিক পেল না।
বিকাশ অ্যাপে বর্তমান একটি অপশন চালু হয়েছে সেভিংস স্কিম নামে, এর মাধ্যমে নির্ধারিত মেয়াদে টাকা সঞ্চয় ও নিরাপদে তা বৃদ্ধি হওয়ার সুবিধা পাওয়া যায়। এখন আমার প্রশ্ন হলো এই পদ্ধতিতে টাকা সঞ্চয় ও মুনাফা গ্ৰহণ অথবা মুনাফার অর্থ নিজে না নেয়ার নিয়তে শুধু সঞ্চয় করণ শরিয়ত কতটুকু সমর্থন করে। দয়া করে সঠিক উত্তর দিয়ে বাধিত করবেন। জাযাকুমুল্লাহু খাইরান।
সমাধানঃ
بسم اللہ الرحمن الرحیم
বিকাশ অ্যাপের একটি অপশন সেভিংস স্কিমের পদ্ধতিতে টাকা সঞ্চয় ও মুনাফা গ্ৰহণ করা সুদ। যা সম্পূর্ণ হারাম। সুতরাং কেউ যদি না জেনে মুনাফা গ্রহণ করে, সে টাকা সওয়াবের নিয়ত ছাড়া সদকা করে দিতে হবে।
সুত্রসমূহ
سورة البقرة: 275 قال الله تعالى: أحل الله البيع و حرم الربا
مصنف ابن أبي شيبة: رقم 20690 عن علي رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: كل قرض جر منفعة فهو ربا
আমি ১ বিঘা জমির উপরে ৫০,০০০ টাকা দিয়েছিলাম। প্রতিবছরে লাভ হিসাবে ৭,০০০ টাকা আসে। দুই বৎসর টাকা দেবার পর ৫ বৎসর যাবৎ টাকার লাভ দিচ্ছে না এবং আসল টাকাও দিচ্ছে না। এখন এই ৫০,০০০ টাকার উপর যাকাত দিতে হবে কিনা?
সমাধানঃ
بسم اللہ الرحمن الرحیم
আপনি জমির উপর টাকা দিয়ে যে লাভ গ্ৰহন করছেন, ঐ লাভের উপর যাকাত আসবেনা। কেননা তা হারাম টাকা। আর আল্লাহ তাআলা একমাত্ৰ হালাল বস্তই কবুল করেন। সুতরাং উক্ত লাভের টাকাগুলো সওয়াবের নিয়ত ছাড়া (হারামের বোঝা থেকে নিষ্কৃতির জন্য) সদকা করে দিতে হবে। আর আপনি যে ৫০,০০০ টাকা জমিওয়ালাকে দিয়েছেন উক্ত টাকার উপর যাকাত ফরয হবে। আপনাকে উক্ত টাকার যাকাত দিতে হবে। উক্ত টাকা হস্তগত হলে বিগত বছরগুলোর হিসাব করে যাকাত আদায় করবেন।
সুত্রসমূহ
الدر المختار: 2/270
كتاب الهنديية: كتاب الزكاة الباب الاول
بدائع الصنائع: كتاب الزكاة فصل الشرائط التي ترجع الي المال
২. সকল ইসলামী ব্যাংক সমূহের লেনদেন শরীয়ত সম্মত কি?
সমাধানঃ
بسم اللہ الرحمن الرحیم
১. মূলত ইসলামী ব্যাংকগুলো সরাসরি টাকা লোন দেয়না, লোন শব্দকে তারা ইনভেস্টমেন্ট শব্দে রুপান্তর করেছে, অর্থাৎ তারা আপনাকে কিছু টাকা দিবে। সেই টাকার মাধ্যমে আপনি আপনার ব্যবসাকে দাড় করাতে পারবেন। আর এ ক্ষেত্ৰে খাতের ভিন্নতা, এলাকার ভিন্নতা হিসাবে ইনভেস্টমেন্ট এর পরিমানেও ভিন্নতা আসবে, তবে তারা ইনভেস্টমেন্ট হিসাবে যে খাতেই টাকা দিক না কেন? রিটার্ন রেট আপনার জন্য প্ৰযোজ্য হবে, যেমন আপনি যদি বাড়ী তৈরী করার জন্য ইনভেস্টমেন্ট নিতে চান তাহলে ১৬.০০% শতাংশ রিটার্ন রেট আপনার জন্য প্ৰযোজ্য হবে।
আপনি যদি ছোট খাটো একটি ব্যবসা করতে চান, এবং এই ব্যবসার জন্য ইসলামী ব্যাংক থেকে ইনভেস্টমেন্ট নিতে চান তাহলে আপনার জন্য ১২ পার্সেন্ট রিটার্ন রেট প্ৰযোজ্য হবে, এই হলো তাদের লোন দেওয়ার সিস্টেম।সুতরাং ব্যাংক আপনাকে লোন হিসাবে (পন্য কিনে না দিয়ে) নগদ টাকা যে নামেই প্রদান করুক না কেন, তার বিনিময়ে রিটার্ন রেট নেওয়া সুদ হিসাবে গন্য হবে এবং এ ধরনের লোন নেওয়া হারাম। হযরত ফাযালা বিন উবাইদ রা. বলেনঃ كل قرض جر منفعة فهو ربا অর্থঃ যেই ঋন কোন মুনাফা নিয়ে আসে তা সুদের প্ৰকার সমূহের একটি। হযরত ইমাম মালেক রহ. বর্ননা করেন যে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেনঃ যে ব্যক্তি কোন বস্তু ঋন দিবে সে যেন অতিরিক্ত কোনো কিছু শর্ত না করে, যদিও তা এক মূঠ ঘাস হোকনা কেন!
আর যদি ঋন (লোন) হিসাবে পন্য যেমন সিমেন্ট, রড বা ব্যবসায়ী সামগ্ৰী দেয়, তাহলে তা শর্তের ভিত্তিতে হলে জায়েয হবে, অন্যথায় জায়েয হবেনা। আর এই লোনটা তখন বায়ে মুরাবাহা হিসাবে ধরা হবে, সুতরাং বায়ে মুরাবাহার যে সমস্ত শর্ত আছে তা পরিপূর্ন ভাবে থাকতে হবে। শর্ত সমূহ থেকে কোন শর্ত না পাওয়া গেলে এই লোনও জায়েয হবেনা।
ইসলামী ব্যাংক সমূহ তাদের ভাষ্যমতে তারা নগদ টাকা গ্ৰাহককে প্ৰদান করেনা। তবে ইনভেস্টমেন্ট হিসাবে নগদ টাকা দেয়, যার আলোচনা সামান্য পরিমান পূর্বে করা হয়েছে, তবে ইসলামী ব্যাংক সমূহের বিনিয়োগের কার্যক্ৰম সমূহ (এটা তাদের ভাষ্যমতে এবং কাগজ কলমে) সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা করা দরকার।
তাদের কার্যক্ৰম সমূহঃ ১. বায়ে মুরাবাহা, ২. বায়ে মুযারাবা, ৩. বায়ে মুয়াজ্জাল, ৪. বায়ে সলম, ৫. মুশারাকা, ৬. হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাতুল মিল্ক, ৭. করজ। ইসলামী ব্যাংকগুলো জনগনের সাথে উপরে উল্লেখিত পদ্ধতিতে বিনিয়োগ করে থাকে, এবং বলে যে তারা উক্ত কারবার করতে গিয়ে ক্ৰয় বিক্ৰয় সমূহে শরীয়ত কর্তৃক যত শর্ত আছে সব শর্ত পুরন করে। কিন্ত অনুসন্ধান করলে বাস্তবে এর ভিন্নতা পাওয়া যায়।
ক. বায়ে মুযারাবা/মুদারাবা। মুযারাবা পদ্ধতি ইসলামী শরীয়তের এমন একটি আদর্শ বিনিয়োগ ব্যবস্থা, যা শরীয়তের স্বাতন্ত্ৰ, সাম্য এবং ইনসাফ ও ন্যায় এর রক্ষাকবচ। কিন্ত প্ৰচলিত ইসলামী ব্যাংকগুলো এ পদ্ধতি পালনে আগ্ৰহী নয়। তাদের বক্তব্য হচ্ছে বর্তমানে মানুষের আমানত-দিয়ানতের অবস্থা অত্যান্ত নিম্নমুখী, তাদেরকে যদি বলা হয় আমরা লোকসান বহন করবো তবে সে ব্যবসায় লোকসান বৈ লাভ কখনো হবেনা, আর সে ক্ষেত্ৰে ব্যবসায়ীদের পাতানো লোকসানের বোঝা বহন করতেই ব্যাংকগুলোর অবস্থা খরাপ হয়ে যাবে। তাই ব্যাংকগুলো বিনিয়োগের ক্ষেত্ৰে মুযারাবা ব্যবসা করেনা।
খ. বায়ে মুরাবাহা। মুরাবাহা ইসলামী ফিকহের ক্ৰয় বিক্ৰয়ের একটি প্ৰকারের নাম, মুলত এটি কোন বিনিয়োগ পদ্ধতি নয়। বর্তমানে ইসলামী ব্যাংক ও আর্থিক প্ৰতিষ্ঠান সমূহের অধিকাংশ বিনিয়োগ মূরাবাহা নামেই হয়ে থাকে। এখানে বলে রাখা দরকার যে, ফিকহের কিতাবে বর্নিত মুরাবাহা ও ব্যাংকগুলোতে প্ৰচলিত মুরাবাহার মাঝে পার্থক্য রয়েছে, ফিকহের কিতাবে বর্নিত মুরাবাহা হচ্ছে কোন ব্যক্তি তার কোন বস্ত ক্ৰয় মূল্যের অধিক দামে অন্যের নিকট বিক্ৰয় করা। এখানে পন্যটা আগের থেকেই বিক্ৰেতার মালিকানায় রয়েছে, এবং তা নগদ বা বাকি যে কোন মূল্যে বিক্ৰি হতে পারে। কিন্তু ব্যাংকের মুরাবাহায় বিক্ৰেতার (ব্যাংকের) নিকট আগে থেকে কোন পন্য থাকেনা বরং ক্ৰেতার (বিনিয়োগ গ্ৰহনকারীর) সাথে বিক্ৰয় চুক্তি সম্পাদনের পর ব্যাংক তা ক্ৰয় করে থাকে। অতপর অধিক মূল্যে বাকিতে/কিস্তিতে বিনিয়োগ গ্ৰহীতার নিকট বিক্ৰি করে থাকে। এ ক্ষেত্ৰে মূল্য আদায়ের সময় বিবেচনায় এনে পন্যের দাম কম বেশী করে থাকে। ইসলামী ব্যাংকগুলোর অবলম্বন করা উক্ত মুরাবাহা যদিও শরীয়তের দৃষ্টিতে কোন আদর্শ বিনিয়োগ পদ্ধতি নয়, তথাপী শর্ত সমূহ যথাযথ পালন করলে তা জায়েযের পর্যায়ে এসে যায়।
১. ব্যাংকের মালিকানায় ও দখলে আসার পুর্বে তা বিক্ৰি করতে পারবেনা।
২. কোন নাজায়েয, হারাম ক্ৰয়-বিক্ৰয় করা যাবেনা।
৩. ব্যাংক যে পন্য গ্ৰাহকের নিকট বিক্ৰয় করবে তা যদি এমন হয় যে, গ্ৰাহক নিজেই এর মালিক, এবং সে ব্যাংকের নিকট তা নগদে বা কম মুল্যে বিক্ৰয় করতে পরে, আবার যদি বাকীতে বেশী মূল্যে ক্ৰয় করে নিচ্ছে তবে কারবারটি হারাম হবে এবং সুদের অন্তর্ভূক্ত হবে।
৪. বাস্তব ভিত্তিক ক্ৰয় বিক্ৰয় হতে কোন ধরনের হীলা বাহানা চলবেনা।
৫. কারবারটি এমন হতে হবে যাতে বাস্তবেই ক্ৰেতার (ক্লায়েন্টের) ঐ পন্যের জন্য অর্থায়ন দরকার। যদি এমন হয় যে, শুধু পন্যের নাম ব্যবহার করে নগদ টাকা বিনিয়োগ নিচ্ছে পন্য কেনার কোনো ইচ্ছা নেই, তাহলে কারবারটি হারাম হবে।
৬. ব্যাংকের নিকট বিনিয়োগ প্ৰার্থী (ক্লায়েন্ট) যদি এমন জিনিস খরিদের নামে টাকা নেয় যা আগেই সে খরিদ করে ফেলেছে অথবা তা কাজেও লাগিয়ে ফেলেছে এখন সে সব পন্যের বকেয়া মূল্য পরিশোধের জন্য অথবা টাকার অন্য কোন প্ৰয়োজন হওয়ায় ঐ পন্যের নামে ব্যাংকের সাথে মুরাবাহা করছে তবে তাও হবে হারাম ও সুদী লেনদেন, উল্লেখ্য যে কখনো ৫ ও ৬ নং এর সমস্যা হয়ে থাকে, এ জন্য ব্যাংক কর্তৃক অনেক ক্ষেত্ৰেই নিজে পন্য খরিদ করতে যায়না, ও তা নিজ রিস্কেও নেয়না।
৭. মুরাবাহার একটি অপরিহার্য শর্ত হলোঃ পন্যটি কিছুক্ষনের জন্য হলেও ব্যাংকের দায়িত্বে ও রিস্কে যেতে হবে, সে সময়ের মধ্যে সেটি নষ্ট বা ক্ষতিগ্রস্থ হলে তা ব্যাংকের ক্ষতি বলেই ধর্তব্য হবে। যদি মুরাবাহার পন্য ক্লায়েন্ট (গ্ৰাহক) কে বিক্ৰির পুর্বে এমন কোনো ঝুকি (রিস্ক) ব্যাংক বহন না করে, তবে লেনদেন হারাম হবে।হযরত মাওলানা তকী উসমানী দা. বা. এবং অন্যান্য ফকীহগনের (যারা ব্যাংকের মুরাবাহারা অনুমোদন দিয়েছেন) মতে এটিই একমাত্ৰ শর্ত যা মুরাবাহাকে সুদী কারাবারা থেকে ভিন্ন করে দেয়। কারন সুদী লোনের মধ্যে ব্যাংক ক্লায়েন্টকে টাকা দেওয়ার পর তার কোনো রিস্ক সে বহন করেনা, এখন যদি মুরাবাহাতেও এমনটি ঘটে এবং গ্ৰাহক তথা ক্লায়েন্টকে পন্য হস্তান্তরের পুর্বে ব্যাংক তার ঝুকি বা রিস্ক গ্ৰহন না করে, তবে কারবারটি হবে সুদী লেনদেনের নামান্তর।
৮. মুরাবাহার আরেকটি শর্ত হলোঃ ক্লায়েন্টের নিকট নির্ধারিত মূল্যে পন্য বিক্ৰি করে দেওয়ায় তার আর মূল্য বৃদ্ধি করা যাবেনা, অর্থাৎ সনাতনী ব্যাংকগুলো যেমন বছরান্তে বা তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী সূদের হাড় বাড়িয়ে দেয়। সেভাবে মুরাবাহা পন্যের মূল্য বৃদ্ধি করা যাবেনা, করলে তা সুদ হবে।
এ দেশের ইসলামী ব্যাংকগুলোর সাথে বিনিয়োগের সমপর্ক রয়েছে অথবা তাদের কারবার সম্পর্কে অবগত আছেন এমন যে সকল পাঠক মুরাবাহার উপরের শর্ত এখানে পড়লেন তারা হয়তো অবাক হয়ে লক্ষ করবেন যে এগুলোর অনেকাংশই ব্যাংক বা আর্থিক প্ৰতিষ্ঠানগুলো পালন করেনা। ক্লায়েন্ট ও অভিজ্ঞ মহল ব্যাংকের মুরাবাহা বলতে বুঝেন কাংখিত টাকার জন্য সে পরিমান মুল্যের মেমো ক্লায়েন্ট কর্তৃক ব্যাংকে হাজির করা, এবং কাগজ পত্ৰের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ক্লায়েন্টকে ব্যাংক কর্তৃক চেক প্ৰদান করা, অনেক ব্যাংকের কর্মকর্তাগনই স্বীকার করে থাকেন যে তারা গ্ৰাহক কর্তৃক প্ৰদর্শিত মেমোর মাধ্যমেই ব্যাংকের খরিদদার হওয়া এবং তা হস্তগত করার দায়িত্ব সমপন্ন করেন। ব্যাংক বা তার প্ৰতিনিধি কর্তৃক প্ৰথমে পন্য ক্ৰয় করে তা হস্তগত করে নিজ রিস্কে নিয়ে অতপর গ্ৰাহককে বিক্ৰি করা এতো কিছুর প্ৰয়োজনীয়তা তারা অনুভব করেননা। কোনো কোনো ব্যাংক অবশ্য গ্ৰাহক থেকে যে সকল কাগজ পত্ৰে স্বাক্ষর নিয়ে থাকে তার মধ্যে একটি ওকালত সমপর্কিত নিয়োগ পত্ৰও থাকে অর্থাৎ ব্যাংক গ্ৰাহককে তার পক্ষ থেকে মালামাল ক্ৰয়ের জন্য প্ৰতিনিধি নিয়োগ করে থাকে, অনেক ক্ষেত্ৰেই ঘটনা এ পর্যন্তই শেষ হয়ে যায়, এরপরই পন্য বিক্ৰয়ের কাগজে স্বাক্ষর রেখে কাংখিত টাকার চেক দিয়ে গ্ৰাহককে ছেড়ে দেওয়া হয়, অথচ ঐ নিয়োগের দ্বারা সে প্ৰতিনিধির দায়িত্ব পেলো মাত্ৰ, এরপর লোকটি যদি সৎ হয় এবং বাস্তবেই ঐ টাকা দ্বারা পন্যটি খরিদ করে তবে ঐ পন্যের মালিক তো হলো ব্যাংক। এখন ব্যাংক তার কাছে বিক্ৰির পুর্বে এটিতো তার পন্য হলোনা, সে ব্যাংকের প্ৰতিনিধি হিসাবে নিজের কাছে তো বিক্ৰয় করতে পারেনা। এ তো গেলো ভালো গ্ৰাহকের কথা যে টাকা দ্বারা পন্য ক্ৰয় করেছে, কিন্তু ব্যাংকের উদাসীনতার সুযোগে অনেক গ্ৰাহক এমনও থাকে যারা বাস্তবে পন্য ক্ৰয়ের কাছেও যায়না বরং কাংখিত টাকা হস্তগত করে তা ইচ্ছামত খরচ করে। আবার কেউ কেউ ঐ টাকা দ্বারা পূর্বে খরিদকৃত পন্নের মূল্য পরিশোধ করে থাকে যা ব্যাংকে যাওয়ার আগেই সে নিজের জন্য খরিদ করেছিলো।
ইসলামী ধারার ব্যাংকিং এর কয়েকটি দিক, ১. মুদারাবা কেনসেপ্ট বা মুনাফার অংশীদারী, ২. মুরাবাহা বিক্ৰি (লোনেৱ ক্ষেত্ৰে) মুশারাকা বা লাভ লোকসানের ভাগাভাগি। আর এই লাভ লোকসানের ভাগাভাগির ক্ষেত্ৰে ইসলামি ধারা মানা হয়না বলে মনে করেন অনেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকার্স এ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি নূরুল আমীন বলেছিলেনঃ ইসলামী ধারার ব্যাংকে লাভ বা ক্ষতির উপর মুনাফার অংশ হেরফের হতে পারে, আগে থেকে কোন কিছু নির্দিষ্ট থাকবেনা। কিন্তু আমাদের দেশের ইসলামী ব্যাংকগুলো আগে থেকেই রেট জানা যায়, যে আমানতকারী কত শতাংশ মুনাফা পাবে! লাভ্যাংশ এর রেট আগের থেকেই নির্ধারিত। এখানে এ কথাও উল্লেখযোগ্য যে, লেনদেনে সুদ থেকে বাচা যেমন জরুরী, তেমনি অন্যান্য নাজায়েয ও নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকাও কর্তব্য, কোন কারবার বাতিল নয় বরং তা ফাসিদ, অথবা পূরো সুদী নয় বরং আংশিক সুদী, শুধু এ কারনে তা জায়েয হয়না। এই হলো বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকগুলোর অভ্যান্তরীন অবস্থা।
২. ইসলামী ব্যাংক সমূহে একাউন্ট খোলার হুকুম। ১. কেউ কেউ বলেন যে, ইসলামী ব্যাংকগুলো তাদের কার্যক্ৰম নিয়ে যে সব দাবী করে থাকেন তা যদি সঠিক হয় তাহলে সেখানে একাউন্ট খোলা জায়েয আছে (যদিও বাস্তবে তারা ইসলামী আইন মানেনা)। ২. আবার কেউ কেউ বলেন যে, বাংলাদেশে কোন ব্যাংকই সঠিক পদ্ধতিতে ইসলামীক আইন মেনে ব্যাংকিং করছেনা। তাই একান্ত প্ৰয়োজন ছাড়া ব্যাংকে টাকা না রাখা ভালো।
তবে একান্ত প্ৰয়োজন হলে কারেন্ট একাউন্ট খোলা জায়েয। ডিপোজিট বা এ জাতীয় দীর্ঘ মেয়াদী কোন একাউন্ট খোলা জায়েয হবেনা।
عبد الله بن مسعود عن ابيه عن النبي صلي الله عليه وسلم قال لعن الله اكل الربا و موكله وشاهديه وكاتبه
অর্থঃ হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. এর পিতা থেকে বর্নিত, রসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেনঃ যে সুদ খায়, যে সুদ খাওয়ায়, সুদের সাক্ষী যে দেয়, সুদের দলিল যে লিখে, তাদের সকলেরই উপর আল্লাহ তাআলা অভিশাপ করেছেন।
তবে যেহেতু বর্তমানে ইসলামী ব্যাংক ছাড়া বাকী ব্যাংকগুলো ব্যাপক ভাবে সুদী কারবার করে থাকে, শরয়ী বিধানের কোন তোয়াক্কাই করেনা, সেই হিসাবে ইসলামী ব্যাংকগুলো শরয়ী বিধান পালনের কিছুটা হলেও চেষ্টা করে থাকে, যদিও পুর্নাঙ্গ আইন তারাও অনুসরন করেনা বলেই আমরা জানি। কিন্তু “মন্দের চেয়ে ভালো অবশ্যই” বলে একটা কথা আছে, তাই অন্য ব্যাংকে একাউন্ট খোলার তুলনায় ইসলামী ব্যাংকে একাউন্ট খোলা নিরাপদ বলেই ধারনা করা হয়, বাকি আল্লাহ তাআলা ভালো জানেন। আর যদি কারেন্ট একাউন্ট খোলা সম্ভব না হয় (কারেন্ট একাউন্ট নাকি শুধু ব্যাবসায়ীদের জন্য, সাধারন লোকের জন্য না), তবে বাধ্য হলে ডিপোজিট ও দীর্ঘ মেয়াদী একাউন্ট খোলাও জায়েয হবে।
ডিপোজিট ছাড়াও শুধু সেভিং একাউন্ট খোলা যায়, যেখানে টাকা রাখলে কোন লাভ্যাংশ দেয়না, বরং উল্টা তারা আরো চার্জ কেটে নেয়। ডিপোজিট শাখায় না রেখে এই শাখায় টাকা জমা রাখবে, ডিপোজিট শাখায় রাখতে পারবেনা। তবে তার মুনাফাটিও সাওয়াবের নিয়ত ছাড়া দান করে দিবে, আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
فمن اضطر غير باغ ولا عاد فلا اثم عليه .ان الله غفور رحيم
অর্থঃ অবশ্য যে লোক অনন্যোপায় হয়ে পড়ে এবং নাফারমানী ও সীমালংঘনকারী না হয়, তার জন্য কোন পাপ নেই, নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলা মহান ক্ষমাশীল এবং অত্যান্ত দয়ালু।
সুতরাং আপনি যদি ইসলামী ব্যাংকে একাউন্ট খোলেন তাহলে আপনাকে এই বিষয়ের প্ৰতি খেয়াল রাখতে হবে, ক. আপনার আসল কত টাকা জমা হচ্ছে সেটা জেনে রাখবেন, দরকার পরলে কোথাও লিখে রাখবেন, আপনি যদি ব্যাংকে টাকা জমা হওয়ার সাথে সাথেই আপনার টাকা উত্তোলন করেন তাহলে তো কোন সমস্যাই নেই, এ ক্ষেত্ৰে আপনি শুধু আপনার মূল টাকাটাই পাবেন। খ. আর যদি আপনি পরবর্তিতে তা উত্তোলন করেন তাহলে আপনি দেখবেন যে, আপনাকে কত টাকা দেওয়া হয়েছে? তা থেকে আপনার মূল টাকা বাদ দিলে কত টাকা থাকে? অর্থাৎ আপনি আগে আপনার মুনাফার সংখ্যা বের করবেন। যদি আপনি নিজে সেটা সম্পর্কে অবগত হতে না পারেন তাহলে ব্যাংকে যার কাছ থেকে টাকা তুলবেন তার সহায়তা নিতে পারেন, তিনিই আপনাকে এই বিষয়ে সাহায্য করতে পারেন, আপনি যদি মূল টাকা হিসেব করে রাখেন তাহলে এটাই উত্তম হবে। আপনার মূল টাকা বাদ দিয়ে যত টাকা থাকে সেটা আপনি গরিব মিসকিনদের মাঝে সাওয়াবের নিয়ত ছাড়াই দান করে দিবেন, সতর্কতা মূলক এই পদ্ধতি অবলম্বন করাই সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতি।
সুত্রসমূহ
سورة البقرة: 275 وأحل الله البيع وحرم الربا
سنن بيهاقي: 5/350
مواطاء مالك: رقم 2513
سورة البقرة: 173 فمن اضطر غير باغ ولا عاد فلا اثم عليه ان الله غفور رحيم
مسند احمد: رقم 3809 عبد الله بن مسعود عن ابيه عن النبي (صلي) قال لعن الله اكل الربا و موكله وشاهديه وكاتبه
আসসালামু আলাইকুম৷ ব্যাংক এ টাকা জমা থাকার কারনে কিছু টাকা (৬০,০০০) সুদ পেয়েছি৷ একটা মিথ্যা মামলার খরচ বহনের জন্য উকিল, পুলিশ, আদালত এ এই টাকা খরচ করা যাবে কি?
সমাধানঃ
بسم اللہ الرحمن الرحیم
শরীয়তে ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত সুদের টাকা দিয়ে কোনো ধরণের উপকার নেয়া জায়েয নেই৷ বরং ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত সুদের টাকা সাওয়াবের নিয়ত ছাড়া গরিবদের মধ্যে অথবা জনকল্যাণমূলক কাজে দান করে দিতে হবে। সাওয়াবের নিয়ত করা যাবে না, কারণ সুদী পন্থায় অর্জিত অর্থের প্রকৃত মালিক আপনি নন। সুতরাং প্রশ্নে বর্ণিত সুদের টাকা দিয়ে মিথ্যা মামলার কাজে খরচ করা জায়েয নেই৷ কেননা, এটা করা মানে সুদের সুবিধা গ্রহণ করা; যা হারাম।
সুত্রসমূহ
مسند احمد: رقم 3809 لَعَنَ رَسُولُ اللهِ ﷺ آكل الربا وموكله وكاتبه وشاهديه، وقال : هم سواء.
আমার একটি কনসালটেন্সি ফার্ম আছে। যার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের সার্ভিস প্রদান করে থাকি। তন্মধ্যে থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ESF এর মাধ্যমে ২% সুদে কৃষি ভিত্তিক শিল্পখাতে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি করে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে দেশের শিক্ষিত, বেকার, কর্মক্ষম যুবক শ্রেনীকে লোন প্রদান করা হয়। এই লোন পেতে উদ্যোক্তারা সাধারণ কনসালটেন্সি ফার্মের মাধ্যমে আবেদন বা কাজ করে থাকে। ইতোমধ্যে অনেক উদ্দোক্তা আমার সাথে যোগাযোগ করেছেন। এখন মুহতারামের নিকট আমার জানার বিষয় হলো। এই লোন প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে উদ্দোক্তাদের সহায়তা করা আমার জন্য শরীয়তের দৃষ্টিতে বৈধ হবে কি? অনুগ্রহ পূর্বক কুরআন-হাদীসের দলীলের আলোকে উত্তর প্রদান করলে কৃতজ্ঞ থাকবো।
সমাধানঃ
بسم الله الرحمن الرحيم
আপনার বর্ননা অনুযায়ী লোন প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে উদ্দোক্তাদের সহায়তা করা আপনার জন্য শরীয়তের দৃষ্টিতে বৈধ নয়, কেননা আপনি সরাসরি সুদী কারবারের সাথে সম্প্রিক্ত না হলেও ব্যাংক থেকে সুদি ঋণগ্রহীতাকে ঋণ গ্রহনের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করছেন, যা সম্পূর্ন অবৈধ ও গুনাহের কাজ, শরিয়ত এমন কাজকে সমর্থন কর না। পূর্বে এমন কাজ করে থাকলে তওবা করতে হবে, মাসআলা জানার পর আগামিতে এমন কাজ করা জায়েয হবে না।